অর্বিট ডেস্ক– লকডাউন পর্বে বহু মানুষের জীবীকা চলে গিয়েছে। বহু মানুষ পেশা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। বিশেষ করে যাঁরা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন বা ঠিকা চুক্তির কাজ করতেন তাঁরা আজ অনেকেই কর্মহীন। অথচ এই সময়েই বেশ কিছু মানুষ নতুন দিশা পেয়ে সফল হয়েছেন। অভিশাপই যেন বর হয়ে উঠেছে। তার মূল কারণ, হতাশ না হয়ে, সঠিক পরিকল্পনা ও বাণিজ্যিক প্রস্তুতি সেরে নিয়েছিল। তাদের সেই বিকল্প আয়ই দেড় বছরে স্থায়ী আয়ের পিলার হয়ে উঠেছে।
আজকের পর্বে থাকছে শাড়ি ব্যবসা নিয়ে খুটিনাটি আলোচনা। যা হয়তো পুরুষ থেকে বাড়ির মহিলাদের সাহায্য করবে। আমরা অনেকেই দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় মূলত ফেসবুক ও ইউটিউবে, অনেকেই শাড়ি, কুর্তি, সালোয়ার বা জামা কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছেন। বেশ কয়েকজন সফলতা পেয়েছেন, আবার কয়েকজন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই প্রতিবেদনে সেই আলোচনাই করবো, তারা কেন সফল হল, আর অসফলতার পিছনে মূল কারণগুলি কী কী?
তবে যে কোনও ব্যবসা করার আগে বেসিক কতগুলি বিষয় জেনে নেওয়া জরুরি।
১। আপনার পুঁজি কত রয়েছে?
২। সেই পুঁজিকে আপনি কোন খাতে মানে প্রোডাক্ট কেনা ও মার্কেটিঙে কীভাবে কতটা ব্যবহার করবেন?
৩। আপনি যে ব্যবসাটি করতে চলেছেন, সেটি সম্পর্কে আগাম ধারণা তৈরি করে নেওয়া, মানে শাড়ির ব্যবসা করলে, ফেব্রিকস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা। নয়তো নিজেও ঠকবেন, আর আপনার ক্রেতাও ঠকবেন। দোষ হবে আপনার।
৪।আর যেটা সবচেয়ে জরুরি, নিজের কাজ ও কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে সততা। এর কোনও বিকল্প নেই। অনেকেই আছে, ফাটকা খেলে, কম সময়ে বহু মুনাফা লুঠে বাজার থেকে হাওয়া হয়ে যান। তাঁদের যদি আদর্শ করেন, তাহলে পরিণতি ভয়ঙ্কর। আর এখন এই কম সময়ে মুনাফা লোটার ব্যবসায়ী ভরে গেছে।
৫। যে ব্যবসা করতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে সঠিক পরামর্শ নেওয়া, সন্দেহ হলে আরও পাঁচ জায়গায় যাচাই করা।
অনলাইন-অলাইন ব্যবসা
একটা সময়ে শাড়ি মানেই ছিল স্থানীয় দোকান ঘর, বা নামে বিখ্যাত দোকান। অনেকেই যেমন কলকাতার আশে পাশের অঞ্চল থেকে শাড়ি কিনতে যান বড়বাজারে। কারণ স্পষ্ট, বহু অপশন যেমন থাকে, তেমন দামও কিছুটা সস্তা পড়ে। এ ছাড়া স্থানীয় বেশ কিছু দোকানও ভালো চলে।
এবার আপনি বিচার করুন একটি স্থায়ী শাড়ির দোকান করতে গেলে প্রয়োজন কম করে ১২০ স্কোয়ার ফিটের জায়গা। সেটি রাস্তার উপরে হলে সবচেয়ে ভালো, ফলে এমন একটি দোকান ভাড়াতে নিতে গেলেও বেশ মোটা টাকা খসাতে হবে। এরপর, কর্মী, মেইন্টেনে্স চার্জ, ইলেকট্রিক খরচ প্রতি মাসে রয়েইছে। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে, আশে পাশের দোকানের সঙ্গে যাতে শাড়ির দাম সামঞ্জস্য থাকে।
এই দোকান চালু হওয়ার পর মূল ক্রেতা কিন্তু এলাকারই, খুব বিখ্যাত দোকান না হলে, বাইরে থেকে কেউ কিনতে আসে না। যদি না হোলসেলার বা ম্যানুফেকচারার্স হন। অর্থাত, দোকানের ক্ষেত্রে একটা বড় লগ্নি প্রয়োজন, তারপর শাড়ির বিভিন্ন আইটেম রাখতে লগ্নি প্রয়োজন। এরপর বিক্রি হোক বা না হোক মাসের একটা রেকারিং খরচ আপনাকে ধরেই রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। মোটামুটি তিন থেকে চার লক্ষ টাকা বাজেট নিয়ে আপনাকে শাড়ি ব্যবসায় নামতে হচ্ছে।
কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়া মূলত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব আসার পর অনেকেই কম খরচে এই ব্যবসা শুরু করে বহু টাকা মুনাফা করতে শুরু করেছেন। আপনারা অনেকেই জানেন, নিজেরা নিজেদের প্রোফাইলের মাধ্যমেই, অনলাইন ব্যবসা শুরু করছেন।
এই ধরণের ব্যবসায় যেমন একটা ভালো দিক আছে, খারাপ দিক সব থেকে বেশি। আপনারা অনেকেই দেখে থাকবেন। নিজের প্রোফাইল থেকে এক জিনিস দেখানো হয়, আর টাকা নেওয়ার পর, অন্য জিনিস পাঠানো হয়। তার প্রোফাইলে গিয়ে কোনও অভিযোগ করলে, সেই বিক্রেতা ব্লক করে দেন। ফলে অনলাইন ব্যবসায় একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়। কিন্তু এই ফেস ব্যবসায়ী আর আসল ব্যবসায়ী চিনবেন কি করে, তার সহজ সরল পদ্ধতি আছে, সে নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করবো। আজ যেটা বলছি, সেটা হল, এই অনলাইন ব্যবসাকে কীভাবে সাকসেসফুল বানানো যায়।
সাকসেসের মূল সূত্র
আগে বলেছি, একটি দোকান করতে গেলে কমপক্ষে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা প্রয়োজন। আর মার্কেট আপনার শুধুমাত্র লোকাল, সব মিলিয়ে হয়তো বাসিন্দা ৫-১০ হাজার। এদের মধ্যে থেকেই আপনাকে ক্রেতা টানতে হবে। কিন্তু অনলাইনে আপনার ক্রেতার সংখ্যা কোটিতে আর লগ্নিও এক ধাক্কা দু গুন কমে যাবে। ফলে ঝুঁকির পরিমাণ যেমন কমবে, সফলতার রাস্তাও প্রশস্ত হবে।
কিন্তু এই অনলাইন মার্কেটে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রথম ধাপ হল, একটি সুন্দর, স্বচ্ছ ই কমার্স ওয়েবসাইট নির্মাণ করা। এই ওয়েবসাইটের বিভিন্ন দিক রয়েছে, তাই দক্ষ কোনও সংস্থাকে দিয়েই করাতে হবে। অনেকেই সস্তায় বানানোর দাবি করে আবার অনেকে বিপুল টাকা দাবি করে। তাই ই কমার্স সাইট করানোর আগে, দক্ষ কোনও ডিজিটাল মার্কেটারের সাহায্য নিন। পুরো বিষয়টি ছবির মতো বুঝে নিন, তার পর সিদ্ধান্ত নিন। অনেকেই এই প্রথম ধাপটি না করে ই কমার্স সাইট বানিয়ে কাজ শুরু করেন, কিন্তু সেখানে কোনও ভিজিটরই আসে না।
একটি ইকমার্স সাইটে যেগুলি থাকতেই হবে-
১। ডেস্কটপ, ট্যাবলেট, মোবাইল ফ্রেন্ডলি হতে হবে।
২। অপটিমাইজেশন ও রেসপন্সিভ সাইট যেন হয়। মানে, সাইট যে কোনও প্লাটফর্মে খোলা হোক, সেটি দেখতে যেন ঠিক ঠাক থাকে আর দ্রুত খোলে।
৩। সাইট যেন সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনে থাকে। অর্থাত (কলকাতায় ভালো শাড়ি দোকান কোনটি) এটি দিয়ে সার্চ করলে যেন আপনার সাইট গুগুলের প্রথম পেজে দেখা যায়।
৪। ই কমার্স সাইটে যেহেতু আপনার প্রোডাক্টের ছবি থাকছে, তাই, ছবির কোয়ালিটি ভালো হতে হবে।
৫। আপনার সাইটের, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে, ভিজিটর ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা থাকে।
এ ছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস রয়েছে, সেগুলি খুঁটিয়ে বুঝে নিতে হবে আপনার ওয়েব ডিজাইনারের কাছে। নয়তো। ঝাঁ চকচকে সাইট দেখতে পাবেন, কিন্তু ক্রেতা আসবে না। সব সময় মনে রাখবেন এটাই কিন্তু আপনার দোকান। লোকে যেভাবে রাস্তায় যেতে যেতে একটি ঝাঁ চকচকে দোকান দেখে ঢুকে পড়ে, এটিও সেই জায়গা। মজার ব্যাপার হল, দোকানে ক্রেতা আসুক বা না আসুক আপনাকে খুলে, একটা লম্বা সময় ধরে বসতেই হবে। অনলাইনে, আপনি সন্ধের পর মাত্র এক ঘণ্টা সময় দিয়ে দেখে নিতে পারেন, আপনার দোকান, কত জন কোথা থেকে দেখে গেছে (দেশ বা বিদেশ) তাদের বয়স কত, কতজন পুরুষ, কতজন মহিলা ইত্যাদি।
আর কেউ অনলাইনে ক্রয় করে থাকলে, তার লিস্ট মিলিয়ে প্রোডাক্ট প্যাক করে তাদের দেওয়া ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া। তাহলে হিসেব যেটা দাঁড়ালো, আপনি লগ্নি কম করলেন, ঝুঁকি কম নিলেন, বহু ক্রেতার কাছে পৌঁছে গেলেন এবং অনেকটা সময়ও বাঁচালেন। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হল, আপনার দোকানে যারা ভিজিট করেছিল, অথচ কেনেনি, তারা ঠিক কোন কোন জিনিস দেখেছে, সেটাও বুঝে গেলেন, কী মজার ব্যাপার নয়?
হ্যাঁ একদম ঠিক তাই, আর এই মজাটি বুঝেই অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন অনলাইন ব্যবসায়।
অনেকে ফেসবুক, ইউটিউবে এমনিতেই শাড়ি বিক্রি করছে, গ্রুপে বা নিজের প্রোফাইল থেকে, সাইট বানানোর কী দরকার?
একদম ঠিক। অনেকেই এভাবে ব্যবসা করছেন। অনেকে ভাবছেন, তাদের বহু সেল হচ্ছে, প্রচুর লোক দেখছে, কমেন্ট করছে। এখানে আমরা সাইট বানানোর কথা বলছি তার অন্যতম কারণ, বিশ্বাসযোগ্যতা। অর্থাত আপনি যে প্রোডাক্ট নিচ্ছে, ঠিক সেটাই পাবেন, তার সিওরিটি, কারণ একটি ওয়েবসাইট চালু করতে গেলে রিটার্ন, পলিসি, প্রিভেসি পলিসি, কুকিস পলিসি, কোম্পানি প্রোফাইল দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফেসবুক ইউটিউবে যাঁরা এমনি বিক্রি করছেন, তাঁদের কোনও দায় নেই। আপনি ঠকলেন মানে ঠকলেন। কারণ তারা অনেকেই বিধি মেনে ব্যবসা করে না। আর তারা নিজেদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট দিয়েই ব্যবসা করে। যা অনৈতিক, অসততার লক্ষণ। তাই এমন ব্যবসায়ীদের থেকে যতটা দূরে থাকবেন ততটাই মঙ্গল।
মনে রাখবেন, ই কমার্স সাইট থাকা মানে আপনার হাতে গ্লোবাল মার্কেট। আপনি হাওড়ার কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লন্ডনেও প্রোডাক্ট পাঠাতে পারেন। আর আনলাইন মার্কেটের ৮৬% ক্রেতা ওয়েবসাইটই খোঁজে।
মার্কেটিং কৌশল
এবার আসা যাক আপনার প্রোডাক্টের বিপণন কৌশলে বা মার্কেটিঙে। ব্যবসার প্রকৃতি অনুসারে তার মার্কেটিং কৌশল ঠিক হয়। তবে যে কোনও প্রোডাক্টের দুটি মার্কেটিং ধারা রয়েছে, ক্লাসিকেল, কার্পেট বোম্বিং আর টার্গেটেড। ক্লাসিক্যাল কার্পেট বোম্বিং হল, টিভি, রেডিও, পেপার, লিফলেট ইমেল মার্কেটিং, এসএম এস মার্কেটিং ইত্যাদি।
আর টার্গেটেড হল, ঠিক সেই ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাওয়া, যে আপনার সমগোত্রের প্রোডাক্টের খোঁজ করছে। অর্থাত যে শাড়ি কিনতে চাইছে, তার কাছেই আপনার বিজ্ঞাপণ যাবে। আর এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে একমাত্র ডিজিটাল দুনিয়ায় আর্টিফিসিলায় ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে। ফলে বিপণনের খরচটাও অনেক কমে গিয়েছে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। বাংলার প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকার একদম প্রথম পাতায় ফুল পেজ কালার বিজ্ঞাপণ দিতে খরচ পড়ে এক কোটি টাকা। হ্যাঁ ঠিক পড়ছেন এক কোটি টাকা। আর সেটা এক দিনেই ঠোঙা। তবু বহুজাতিক কোম্পানিগুলি দিয়ে থাকেন। কারণ, এখনও দেশের সমস্ত ক্রেতা ডিজিটাল নির্ভর হয়ে ওঠেনি। তাঁদের সাইকোলজি ডিজিটালের থেকে পেপার টিভি, রেডিও অনেক বেশি বিশ্বস্ত জায়গা। আর এই একই টাকায় ডিজিটাল প্লাটফর্মে সারা বছর একাধিক ডোমেনে বিজ্ঞাপণ দিতে পারে সংস্থাগুলি।
তবে যাঁরা ছোট উদ্যোগী রয়েছে, তারাও একটা মার্কেটিং বাজেট সেট করে কৌশলী বিজ্ঞাপণ সারতে পারেন। এতে খরচ যেমন কম হবে, সরাসরি ক্রেতার কাছেও পৌঁছনো যাবে। তবে মনে রাখবেন, অনেকেই, ফেসবুকে নিজেরা শাড়ির ছবি দিয়ে প্রোমোট করেন। অর্থাত ফেসবুক পোস্টিং মানেই ডিজিটাল মার্কেটিং নয়। কন্টেন্ট ব্র্যান্ডিং, ইলাস্ট্রেশন পুশিং না হলে কিস্সু হবে না। তাই সেগুলো বিচার করে নেবেন।
শাড়ির ব্যবসা করতে চাইলে, ডিজিটাল মার্টেকিঙের তিনটি প্লাটফর্মকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও গুগুল অ্যাডওয়ার্ড।
ব্যবসার আইডিয়া বা মার্কেটিং সংক্রান্ত যে কোনও প্রশ্নে হোয়াটস অ্যাপ করতে পারেন 9073503958 নম্বরে