স্বাতী চ্যাটার্জি– আরাবল্লীর কোল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক সন্তান। গত কয়েক দশকে প্রায় ৩১টি সন্তান নিখোঁজ হয়েছে। এই কথাটা শুনে কি হেঁয়ালির মতো লাগছে? তাহলে আসল কাহিনিতে আসা যাক।
আজ আমরা যে পর্বত শৃঙখলার কথা বলবো, তা এ ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে পুরনো পর্বতগুলির মধ্যে অন্যতম। পর্বতের নাম আরাবল্লী। এই পর্বত শৃঙ্খলা ভারতের উত্তর পশ্চীম এলাকায় অবস্থিত। আরাবল্লীর বিস্তার উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণপশ্চিম দিকে। রাজ্যের হিসাব করলে, হরিয়ানা, রাজস্থান হয়ে চলে গিয়েছে গুজরাটে।
আপনার জানলে হয়তো অবাক হবেন। আরাবল্লীর ইতিহাস, আমাদের দেশ ভারতের থেকেও পুরনো। গবেষকদের মত, এই পর্বত তখন থেকে রয়েছে, যখন ভারত বা এই উপমহাদেশের জন্মই হয়নি। এমনকি তখনও হিমালয়ের জন্ম হয়নি। পর্বত গবেষকদের মত, এই উপমহাদেশে একমাত্র আরাবল্লী পর্বত শৃঙখলাই ভারতীয় উপমহাদেশে মানচিত্র তৈরি থেকে জলবায়ুর অবস্থা কেমন হবে, তা প্রকৃতিগতভাবে নির্ধারণ করেছিল। ভূমণ্ডল গবেষকদের মত, ৭৫০ মিলিয়ন বছর আগে মালানি আগ্নেগিরির কারণে, শীতল যুগ থেকে টেনে বের করে এই অঞ্চলকে জীব বৈচিত্র্যের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করেছিল।
আরাবল্লীর অজানা আটকাহন
আর এই পর্বত শৃঙ্খলা এখনও রাজস্থানের মতো তৃষ্ণার্ত এক রাজ্যকে জলদান করে চলেছে। বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রপতি ভবন, যে রাইসিনা হিলের উপর অবস্থিত, তাও আরাবল্লী পর্বতের অংশ। অতএব বোঝাই যাচ্ছে আমাদের দেশের জন্য, পরিবেশের জন্য আরাবল্লী পর্বতমালা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি খবর জেনে হয়তো অবাক হবেন। কয়েক কোটি বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আরাবল্লী পর্বতমালার উপর গত চার দশকে যা অত্যচার হয়েছে, তাতে এই শৃঙ্খলা ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড কমিটি তৈরি করে। সেই কমিটির রিপোর্ট অনুসারে, রাজস্থানে অবস্থিত আরাবল্লী পর্বত মালার ১২৮টি পাহাড়ের মধ্যে ৩১টি উধাও হয়ে গিয়েছে। শুধু রাজস্থানেই আরাবল্লী পর্বমালার ২৫ শতাংশ আধুনিক নগরায়নের ফলে জমি থেকে উৎখাত হতে হয়েছে। এদিকে হরিয়ানা সরকারের প্রিন্সিপল সেক্রেটারি এ কে সিঙের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টেও দাবি করা হয়েছে, হরিয়ানাতে আরাবল্লী রেঞ্জের সাইজ আগের থেকে অনেকটা ছোট হয়ে গিয়েছে।
আরাবল্লী শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ আরা ও বলী থেকে অর্থাৎ পর্বত রেখা। প্রায় ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন বছর আগে এই পর্বতের জন্ম। এটি একটি ফোল্ট মাউন্টেন হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, যখন ভূমির দুটি ভিন্ন টেকটোনিক প্লেট মুখোমুখি সংঘর্ষে উপরের দিকে উঠে আসে, তাকে ফোল্ড মাউন্টেন বলা হয়। তবে এটি কোনও এক সময়ের শুধু মহাজাগতিক ঘটনা নয়, এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে হাজার লক্ষ বছর ধরে।
আরাবল্লীর মতো আমাদের হিমালয় পর্বত মালাও একটি ফোল্ড মাউন্টেন। তবে আরাবল্লীর তুলনায় হিমালয় অনেক বয়স কম। তাই এখনও হিমালয় রেঞ্জে টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান বদলের জন্য হিমালয় এখনও বাড়ছে। ফলে ওই অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবেও চিহ্নিত। হালেই আপনারা জেনেছেন, জোশীমঠের কথা, ধীরে ধীরে কীভাবে বসে যাচ্ছে জোশীমঠ। এটা তারই একটি কারণ। তবে আরাবল্লী একটি ওল্ড ফোল্ড মাউন্টেন রেঞ্জ।
পরিসংখ্যান বলছে, গুজরাট থেকে হরিয়ানা পর্যন্ত আরাবল্লী রেঞ্জ ৬৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। গবেষকদের দাবি, এটি একসময় হরিদ্বার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ফলে, এই পর্বতমালাকে গঙ্গা এবং ইন্দাস নদীর ন্যাচারাল ডিভাইডার হিসেবে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, বর্ষাকালে, সজলধারা মেঘকে শিমলা ও নৈনিতালের দিকে ধাক্কা দিকে আরাবল্লীর ভূমিকা অপরিসীম। এরই ফলে, উত্তরভারের একাধিক রাজ্যে বর্ষার জল ছড়িয়ে পড়ে ও ভারসাম্য রক্ষা করে। অন্যদিকে, শীতকালে সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আগত শৈতপ্রবাহকে বাধাদান করে, ফলে গঙ্গা ও ইন্দাসের জল জমে বরফ হয়ে যায় না। রাজস্থানের থর মরুভূমি যে প্রকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে একই কাজ করে থাকে আরাবল্লী।
এই বিস্তির্ণ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষাতেও অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে আরাবল্লী। ২০টির উপর বণ্যপ্রাণ স্যাঙচুয়ারির সঙ্গে সরিস্কা দিল্লি লেপার্ড ওয়াইল্ডলাইফ করিডোরের ভারসাম্য বজায় রাখে। পাশাপাশি ৩০০-র বেশি প্রজাতির স্থানীয় গাছপালা, গুল্ম, লতার আবাসভূমি। ১২০টির প্রজাতির পাখিরও চারণভূমি। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে আরাবল্লীর গুরুত্ব কতটা।
এতো গেল বন্যপ্রাণের কথা, আরাবল্লীকে দিল্লি এনসিআরের ফুসফুস বলে মনে করা হয়। এখানকার দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আরাবল্লীর জঙ্গল এক বরদান। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, এই অঞ্চলে ৫ খ্রিস্টপূর্ব্দ থেকে কপার এবং অন্য ধাতুন খনন কাজ শুরু হয়। এমনকী, রাজস্থানে আমরা যে টানে বেড়াতে যাই তা হল, বিখ্যাত কেল্লা। সেই সব স্থাপত্যের পিছনেও অবদান রয়েছে আরাবল্লীর। ঐতিহাসিকদের মত, এই অঞ্চলে একসময় আহাদ, গিলুন্ড এবং বৈরাথের মতো সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল।
আশ্চর্যের বিষয়, অর্থৈনিত, প্রকৃতিক এবং ভৌগলিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এই পর্বতের ধীরে ধীরে ক্ষয়রোগ আক্রান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ক্ষয়রোগের কারণ কী?
আরাবল্লীর পতনের কারণ
আরাবল্লী লক্ষাধিক বছর ধরে মানব সভ্যতার সমস্ত চাহিদা পূরণ করে এসেছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে, নির্মাণ ব্যবসা ক্ষেত্রে এবং নগরায়ণের ফলে টুকরো টুকরো করে উধাও করে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক যেভাবে, হায়নারা, একটা জীবন্ত প্রাণীকে কুরে কুরে খায়। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আরাবল্লীর ৩২০০টি জায়গায় অবৈধ খননকাজ চলছে।
পাশাপাশি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেলনারেলের একটি রিপোর্টেও দাবি করা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৯৮.৮৭ লক্ষ মেট্রিক টন খনিজ পদার্থ অবৈধভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে। অসৎ রাজনৈতিক নেতা এবং ভূমি মাফিয়াদের দৌরাত্মে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আরাবল্লী। সূত্রের খবর, আরাবল্লী থেকে খনিজ পদার্থ তোলার জন্য মাফিয়ারা ডিনামাইটও ব্যবহার করছে। এর ফলে, শুধু পাহাড়ের প্রকৃতিক বাঁধনই নষ্ট করছে না, পাশাপাশি গোপন পথের মাধ্যমে পাচারও করছে। বলা বাহুল্য, মাইনিং মাফিয়ারা, নির্ভয়েই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বেলাগাম নগরায়ন ও লোভের কবলে
গত কয়েক বছরের রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায়, এই অঞ্চলে মাইনিং মাফিয়া এবং পুলিশকর্মীদের মধ্যে একাধিক এনকাউন্টার হয়েছে। এমনকী, পুলিশকর্মী, সরকারি পদস্থ আধিকারিকদের হত্যাও করা হয়েছে। রাজস্থান, হরিয়ানা ও দিল্লি এনসিআরে দ্রুত হারে বাড়ছে নগরায়ন। আর প্রত্যেকটি জায়গার নির্মাণশিল্প ফুলে ফেঁপে উঠছে আরাবল্লীকে ধ্বংস করে। দিল্লি এনসিআরে উন্নয়নের জন্য লাগামছাড়া ভাবে গাছগাছালি কাটা হচ্ছে, ফলে ধীরে ধীরে ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গল তৈরি হচ্ছে আধুনিকতার নামে। মজার ব্যাপার, এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া বদলে, সরকারের তরফে যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা অত্যন্ত হাস্যকর। ১০০০ টাকা থেকে ১১০০০ টাকা জরিমানা নিয়ে মামলা খতম করে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৯২ সালে কেন্দ্র সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক আরাবল্লী নোটিফিকেশন জারি করে বলেছিল, কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া কোনও মাইনিং কাজ করা যাবে না। এমনকী, ২০০২, ২০০৫,২০০৯ এবং ২০১৮ সালে ভিন্ন মামলায় সুপ্রিম কোর্টও নির্দেশ জারি করে, আরাবল্লী রেঞ্জে মাইনিং করা যাবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র একদম ভিন্ন। এনফোর্সমেন্টের অভাবে, সেই সব নির্দেশনামা আস্তাকুঁড়ে পড়ে রয়েছে। বর্তমানে অবৈধ মাইনিংতো দূর অস্ত, প্রকৃতি বাঁচাতে মাইনিং বন্ধ করারও নির্দেশ দেয়নি কোনও সরকার। শুধু তাই নয়, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, হরিয়ানা সরকার বহু বন্যভূমিকে সাধারণ ভূমি করে জঙ্গল সাফাইয়ে ছাড়পত্র দিয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, সারা ভারতে রাজ্যের বিচার করলে হরিয়ানাতেই সবচেয়ে কম বনভূমি রয়েছে।
অদ্ভুত তুঘলকী সিদ্ধান্ত
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হরিয়ানা সরকারের প্রিন্সিপল সেক্রেটারির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি সুপারিশ করে। আরাবল্লীর বিস্তারকে পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ। অর্থাৎ ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল এবং অন্যান্য আইনি জটিলতাকে পাস কাটিয়ে যাতে পাহাড় ও অরণ্য ভূমি মাফিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর সেই রিপোর্টকে হাতিয়ার করে, হরিয়ানা সরকার, আরাবল্লীর একটা অংশের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে।
এখানেই পরিবেশ কর্মীরা ক্ষোভ দেখাতে থাকে। তাঁদের অভিযোগ, মহেন্দ্রগড়, ফরিদাবাদ এবং পালওয়াল অঞ্চলের ৩৫ হাজার হেক্টর জমিকে সাধারণ জমি বলে, ভূমি মাফিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি রিপোর্ট বলছে, স্রেফ রাজস্থান থেকেই ৩১টি পাহাড় গায়েব হয়ে গিয়েছে। আর তার বদলে রাজস্থান সরকার বছরে ৫০০০ কোটি টাকা রয়ালটি নিয়ে কোষাগার ভরেছে।
আরও পড়ুন- শীতের আমেজে কাটিয়ে আসুন অফবিট উইকেন্ডে
আরও পড়ুন- জানুন ত্রিম্বকেশ্বর মন্দির সম্পর্কিত সম্পূর্ণ তথ্য