Breaking News

লাচেত বরফুকান, ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া এক নায়কের বীরগাথা

অর্বিট নিউজডেস্ক– রাজা মহারাজাদের দেশ ভারত। কত যুদ্ধ, কত রক্তক্ষয়, কত ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে কালো হরফে। বহু ইতিহাস আজ স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে। আজকের প্রতিবেদনে তেমনই এক ইতিহাসকে ফিরে দেখা।

অসমতো অনেকেই গিয়েছেন, কিন্তু সরাইঘাট যুদ্ধের কথা মনে আছে কি ? একবার আলো ফেলা যাক ইতিহাসের সেই পাতায়।

১৬৭১ সালে সরাইঘাট যুদ্ধ হয়েছিল মুঘল ও অহম সাম্রাজ্যের মধ্যে। যা ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অধুনা গুয়াহাটি শহরে অবস্থিত। এই যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় ততটাই তাৎপর্যপূর্ণ যতটা হলদিঘাট বা ঝাঁসির লড়াই, কারণ এই লড়াই হয়েছিল জলপথে ও স্থলপথে।

এই প্রতিবেদনে মূল পাঁচটি বিষয় উঠে আসবে।

১। অহম রাজ্য কার ছিল, বা তাদের অস্তিত্বটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

২। মুঘল ও অহমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কী নিয়ে ছিল ?

৩। লাচেত বরফুকান কে ?

৪। সরাইঘাট যুদ্ধের কারণ ?

৫। যুদ্ধের পর পরিণতি কী হয়েছিল ?

তাহলে শুরু করা যাক, অহম সাম্রাজ্যের সূচনাকে ঘিরে। ১২২৮ খ্রিঃ এই অহম সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, আর এই সাম্রাজ্য চলেছিল ১৮২৬ পর্যন্ত। প্রায় ৬০০ বছর চলেছিল অহম সাম্রাজ্য। আর এই সাম্রাজ্যের চাকা গড়িয়েছিল সুকফা নামে এক রাজার হাত ধরে। তিনি এসেছিলেন মায়ানমারের শান প্রদেশ থেকে। এটি মায়ানমারের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। তারা এসেছিল পটকাই পাহাড় পার করে।

সময়ের সঙ্গে বিস্তার হয় সাম্রাজ্যের পুরো ব্রহ্মপুত্র তট জুড়ে ছিল অহম রাজ্যের বিস্তার। সময়ের সঙ্গে রাজ্যের রাজধানীও বদলেছিল, কখনও গরগাঁও, জোড়হাট। মধ্যযুগে অহম রাজ্যের রাজাদের বলা হত, অসম রাজা। যদিও স্থানীয়রা তাঁদের বলতেন চাওফা। চাও শব্দের অর্থ শাসক আর ফা শব্দের অর্থ স্বর্গ। চাওফার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, স্বর্গের শাসক। এই নাম মূলত পাওয়া যায় ১৬ শতাব্দী থেকে।

অহম রাজারা মায়ানমার থেকে এলেও, তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও, ভারতে আসার পর, তারা হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়। স্থানীয় সংস্কৃতিও তারা গ্রহণ করতে শুরু করে এবং তার বাড়বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। স্থানীয়দের কিংবদন্তি রয়েছে, অহম রাজারা দেবরাজ ইন্দ্রের বংশধর।

১৯০১ সালের জনগণনা অনুসারে অসমের ১০ শতাংশ মানুষই বলেছিলেন তারা অহম। বর্তমান পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে এখনও ১০-২৫ শতাংশ নাগরিক আসলে অহম।

অহম রাজ্যে যারা মন্ত্রী হতেন, সেখানে মূলত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পদ লক্ষ্য করা যেত।

*বরঘোঘোঁয়াই, *বরঘোঁয়াই, *বরপাত্রঘোঁয়াই, *বরবড়ুয়া, *বরফুকান।

বরফুকান সেনাপ্রধানকে বলা হত।

আগেই বলেছি, এই অহম রাজ্য চলেছিল প্রায় ৬০০ বছর। অজেয় একটি সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, ব্রিটিশ এবং মায়ানমারের যুদ্ধের সময়।

১৮১৭ থেকে মায়ানমারের সাম্রাজ্য লাগাতার অহম সাম্রাজ্যের উপর হামলা চালায়। ১৮২১ সালে অহম সাম্রাজ্য মায়ানমার বা বার্মার অধীনে চলে যায়। কয়েক বছর পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মাকে হারিয়ে দেয়। এই সময় ইয়ান্ডাবো চুক্তি হয়। এবং বার্মাকে বেশ কয়েকটি শর্তে আবদ্ধ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, অহম রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে। সেই সময় পুরোপুরি অসামের উপর দখল জমায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অহম সাম্রাজ্য শেষ হয়।

এর আগের ইতিহাসটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ ১৬ এবং ১৭ শতাব্দীর। এই সময় উত্তরপূর্ব ভারতে বেশ কয়েকটি বড় স্বাধীন সাম্রাজ্য ছিল। পাশে ছিল কোচ সাম্রাজ্য অধুনা কোচবিহার। উত্তরে ভুটান, দক্ষিণে জয়ন্তিয়া পূর্বে মণিপুর, দক্ষিণ পূর্বে কাচার এবং ভারতের অধিকাংশই তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন। সেই সময় অবিভক্ত বাংলাও মুঘলদের দখলে।

শুরু থেকেই মুঘল ও অহম সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না, কারণ, ১। মুঘলরা প্রথমে কোচবিহারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। আর কোচবিহারের সঙ্গে অহমের শত্রুতা দীর্ঘ সময় ধরে ছিল। ২। মুঘল চাইছিল উত্তর পূর্ব ভারতে দখল জমাতে। এটি আকবরের সময় থেকেই চলতে থাকে। ৩। আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্রহ্মপুত্র তটে যত উর্বর জমি রয়েছে, সেগুলি নিজেদের দখলে রাখা।

যখন থেকে মুঘল অহম সাম্রাজ্য দখল নেওয়ার চেষ্টা করে সেই সময় থেকে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে, ফলে প্রভাব পড়তে থাকে বাণিজ্য এবং সীমানার ক্ষেত্রে। ১৬১৫ সালে মূল সমস্যার শুরু হয় কোচবিহারের জন্য। সেই সময় লড়াই শুরু হয় চলে ১৬৮২ পর্যন্ত। মাঝে ১৮টি বড় ধরণের লড়াই চলে। এই ১৬১৫ সালে বা তার আশে পাশে কোচবিহারের দুই ভায়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়, রাজ্যকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাইকে মুঘল সাপোর্ট করে, অন্যকে অহম। এর পরেই সম্মুখ সমরে আসে অহম ও মুঘল। এটি চলেছিল ১৬৮২ সাল পর্যন্ত। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব বারবার আক্রমণ চালিয়েও প্রতিহত করতে পারেনি অহম সাম্রাজ্যকে।

আরও পড়ুন- নৃসিংহপুরের রাজবাড়ি কেন অভিশপ্ত? কী এমন অঘটন ঘটে?

আর এই লড়াইয়ের অহম সাম্রাজ্যের মধ্যে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে রচিত তিনি হলেন লাচেত বরফুকেন। ১৬২২ সালে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন মোমাই তামুলি। তিনি ছিলেন বরবড়ুয়া একটি বড় অঞ্চলের প্রশাসক। লাচেতকে কলা, দর্শন, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং ধর্মীয় আচার রীতির প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। লাচেত অহম সাম্রাজ্যের ভিন্ন সেনাদলে নোতৃত্ব দেন। পরে তিনি রাজ্যের সেনা প্রধান হয়ে ওঠেন।

১৬৬৭ সালে মুঘল যখন গুয়াহাটি হামলা চালায় এবং দখল জমায়। যদিও ১৬৭১ সালে ফের গুয়াহাটি অহমের দখলে আনেন লাচেত। তিনি সেনা প্রধান ছিলেন এই সরাইঘাট যুদ্ধে। ২৪ নভেম্বর লাচেতের জন্মদিন, আর এই দিনকে স্মরণ করেই, অসামে এখন উৎসব পালন করা হয়।

লাচেতকে ঘিরে বেশ কিছু কিংবদন্তি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম, সরাইঘাট যুদ্ধের সময় যখন তিনি নিজের সেনার বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সময় প্রতিরক্ষার স্বার্থে একটি দরজা তৈরির কাজ দেওয়া হয় তাঁর মামাকে। তাঁর মামা সেই কাজ সম্পূর্ণ করেনি। কাজ ঠিক হয়েছে কিনা দেখতে গিয়ে দেখেন প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত কাজ অসম্পূর্ণ, সেই সময় তার মামার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দেয়। এবং সে বলে, আমাদের দেশের আগে আত্মীয় বড় নয়।

আরও এক ঘটনা শোনা যায়, সরাইঘাট যুদ্ধে একবার আহত হয়, তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। তিনি খবর পান সরাইঘাট যুদ্ধে অহম সেনা হারতে বসেছে, সেই সময় অসুস্থ অবস্থাতেই লাচেত জলপথে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের বলেন, তোমরা চাইলে চলে যেতে পারো, আমি লড়াই চালিয়ে যাবো, তবে রাজাকে খবর দিও লাচেত বরফুকেন তাঁর দায়িত্ব থেকে পিছপা হয়নি।

আরও পড়ুন- আন্দুল রাজবাড়ি নিয়ে ভ্রান্ত তথ্য ও ভুতুড়ে গল্প

সরাইঘাটের যুদ্ধ-

১৬১৫ থেকে মুঘল ও অহমের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। ১৬৬১ সালে মুঘলের বিশাল সেনার দল বড়গাঁওয়ে পৌঁছে যায়। এবং অহম রাজাকে হারিয়ে দেয়। সেই সময় অহম রাজাকে একটা সন্ধি করতে হয়। সেই সময় মুঘলকে বিশাল অঙ্কের টাকা এবং গুয়াহাটিও দিতে হয়। মূলত কামরূপ এলাকা মুঘলদের দখলে যায়। এর পরেই লাচেতকে সেনাপ্রধান করা হয়, তারই নেতৃত্বে ১৬৬৭ সালে পুরনায় গুয়াটিতে হামলা চালায়। এবং তা জিতে নেয়।

এই খবর ঔরঙ্গজেবের কাছে যখন যায়, তখন আমেরের রাজা রাম সিংকে পাঠায়। তিনি রাজপুত ছিলেন। এবং রাজা জয়সিঙের পুত্র ছিলেন। রাজস্থান থেকে সেনার দল আসে আসামে ১৬৬৯ সালে অসমে হামলা চালায় মুঘল। সেই সময় অহমের রাজা ছিলেন চক্রধ্বজ সিংহ।

যেহেতু মুঘল সেনার সংখ্যা বেশি ছিল, তাই লাচেত প্রথমে কথাবার্তার কৌশল নেয়, আসলে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য যাতে হাতে বেশি সময় পাওয়া যায় তারই কৌশল ছিল লাচেতের। ১৬৬৯ থেকে ৭০ পর্যন্ত লড়াই চলে, সেই সময় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অহম সেনার দল।

প্রায় দেড় বছর যুদ্ধ চলার পর সামনাসামনি যুদ্ধে নামে মুঘল এবং অহম। এই যুদ্ধে প্রায় অহমের প্রায় ১০ হাজার সেনার মৃত্যু হয়। দুর্বল হয়ে পড়ে অহম। এই সময়ই মারা যায়, চক্রধ্বজ সিংহ। অলাবোই এলাকা মুঘলদের দখলে যায়। তখনই রাজার মৃত্যুর পর, তার ভাই উদাদিত্য সিংহ রাজা হয়। এর পরেই সিদ্ধান্ত নেয়, মুঘলদের বিরুদ্ধে আসল লড়াইটা চালাতে হবে গুয়াহাটিতে। যেহেতু ওই অঞ্চল পাহাড়ি এলাকা, তাই প্রতিরক্ষা অনেকটাই শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয় বিষয় হল, গুয়াহাটি পার না করতে পারলে অহম রাজ্যে মূল অংশে ঢোকা মুশকিল।

এ ছাড়াও পুরো এলাকা, পরিবেশ অহমের অনুকূলে ছিল, পাহাড়ি এলাকা থাকার দরুণ হাতি ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধে করা মুঘলদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদী, একমাত্র গুয়াহাটি অঞ্চলে তার বিস্তৃতি ১ কিলোমিটার চওড়া, বাকি অন্য জায়গা সাত থেকে আট কিলোমিটার চওড়া ফলে জলপথে মুঘলদের লড়াই করার ক্ষমতাও অনেকটা কম।

এদিনে রাজা রামসিংহের সেনা ছিল, পাশাপাশি বাংলা থেকে শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার নৌসেনা নিয়ে গুয়াহাটি পৌঁছয়। যুদ্ধ শুরু হয়, এই সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে লাচেত। চিকিৎসক জানায়, এই শরীর নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া উচিৎ নয়। এদিকে মুঘল সেনার দাপটে প্রায় পর্যুদস্ত অহম সেনা। এই খবর পাওয়ার পরেই, লাচেত নৌ পথে যাত্রা শুরু করে। আর অসুস্থতার মধ্যেই বরফুকনের উপস্থিতি অহম সেনার মধ্যে বাড়তি শক্তি জোগায়। এখানেই প্রথম নৌকাসেতু তৈরি করে যুদ্ধ চালায় অহম সেনা।

যেখানে ছোট নৌকাগুলিকে জুড়ে সেতু বানিয়ে মুঘল সেনার ছাউনিতে হামলা চালায়। এই যুদ্ধে মুঘল সেনার বেশ কিছু কমান্ডারের মৃত্যু হয় এবং ৪ হাজার সেনার মৃত্যু হয়। পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে মুঘল সেনা। অগত্যা পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। এই সরাইঘাটের যুদ্ধ ১৬৭১ সালে মার্চ মাসে হয়েছিল বলে জানা যায়। পরের মাসেই কামরূপ থেকে সেনা সরিয়ে নেয় মুঘল। এক বছর পর ১৬৭২ সালে লাচেত বরফুকনের মৃত্যু হয়। এর পরেও মুঘল ও অহমের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে, কখনও গুয়াহাটি, কখনও ইটাখুলি এলাকা দখল করে মুঘলরা।

সেই সময় লাচেতের ভাই লালুক সোলা সেনাপ্রধানের কাজ করতে থাকে। ১৬৮২ সালে ফের একবার মুঘল ও অহমের মধ্যে চরম লড়াই হয়, এবং মুঘল পিছু হটতে বাধ্য হয়। যদিও তার পর আর অহম সাম্রাজ্যের দিকে ঘুরে তাকায়নি মুঘল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করার আগে পর্যন্ত ২০০ বছর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই ছিল অহম।

ইতিহাসমূলক রচনা, প্রতিবেদন পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

কাশ্মীরের এই পাঁচটি জায়গা একদম অফবিট, এবারে সফরের তালিকায় অবশ্যই রাখুন

স্বাতী চ্যাটার্জি- ভূস্বর্গ কাশ্মীর, মুঘল সম্রাট এই উপত্যকা দেখার পর বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!