Breaking News

‘ইলে দা মরচে’ বাংলার কালো অধ্যায়ে জলদস্যুদের এক ভয়ঙ্কর দ্বীপের কথা

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– হুগলি নদী যেখানে বঙ্গপসাগরে মিশেছে, তার দক্ষিণে প্রায় ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে একটি দ্বীপ ছিল, ইলে দা মরচে। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় মৃত্যু দ্বীপ। দ্বীপটি ছিল অনেকটা নাঙলের আকৃতির। মাপ ছিল ১০ বর্গ কিলোমিটার।

আর আমি যে সময়টার কথা বলছি, সেটা ১৫২৮ থেকে ১৬৩২ এর মধ্যে। তবে এই দ্বীপের ভয়ঙ্কর কাহিনি বলার আগে, একটু গোড়ার কথা বলে নেওয়া যাক। বঙ্গোপসাগরের জলে যে মর্মান্তিক, ভয়ঙ্কর এক ইতিহাস মিশে আছে, কয়েক গণ্ডুষ তা তুলে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা যাক। আমরা অনেকেই জানি পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই ভারতের পশ্চিম পাড়ে ধীরে ধীরে ঘাঁটি গেড়েছিল পর্তুগিজরা। প্রথমে বাণিজ্য, তারপর কয়েকটি রাজ্যকে নিয়ে ক্ষমতা কায়েম। পরিধি বাড়াতে শুরু করলো তারা। আরব সাগর থেকে দক্ষিণের অভিমুখ নিয়ে, ভারত মহাসাগর হয়ে ঢুকলো বঙ্গোপসাগরে। স্টেট অফ ইন্ডিয়ার একটি অভিযাত্রী দল, চারটি বড় জাহাজে করে ১৫১২ সালের ৯ মে বাংলার চট্টগ্রামে নোঙর ফেলল। সেই দলের প্রধান ছিল জাও দা সিলভেরা।

বাংলার সুলতানকে তারা স্বপ্ন দেখালো। বাণিজ্য, অতিরিক্ত উপার্জন ও প্রজাদের বিপুল কর্মসংস্থানের। সুলতান সনদে রাজি হল। দেখলো, পশ্চিম ভারতের বোম্বে, দক্ষিণে সেলন (শ্রীলঙ্কা), মালাক্কার বিপুল পরিবর্তন। বাংলার সুলতান, চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস হাউস ও আশে পাশে ক্লিয়ারেন্স হাউস তৈরির অনুমোদন দিল। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বন্দর সেজে উঠলো কেল্লায়, সুরক্ষার জন্য তৈরি হল নৌসেনা ছাউনি।

সময় গড়ায়, সুলতানের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ মাখো মাখো হয়ে ওঠে ফিরিঙ্গি বণিকদের। আর বণিকরাও পেল এক স্বর্ণ পথের সন্ধান। গোটা ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য ও রাজত্ব করার এতো ভালো জায়গা তারা আগে দেখেনি। আশেপাশে ছোট ছোট রাজ্য ও দেশগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক অজেয় প্রাকৃতিক কেল্লা এই চট্টগ্রাম বন্দর।

চট্টগ্রাম লাগোয়া রয়েছে একটি বড় সমুদ্র সৈকত এলাকা, যার নাম রাখাইন উপকূল। আর উপকূল ও বন্দর লাগোয়া রয়েছে বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপ। তার মধ্যে কয়েকটি দ্বীপ ছিল সেই সময় বাংলাদেশের বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের। তার কাছে আবেদন করা হয়, দ্বীপগুলি তাদের দিয়ে দিতে। কেদার রায় আপত্তি করলে, পর্তুগিজ বাণিকের একটি দল আসল রূপ দেখায়, সরাসরি দখল করে নেয় তারা।

ঘটনাটা ঘটে যখন বাংলায় সুলতানি আমল দুর্বল। পর্তুগিজ বণিকের একাংশ যে দ্বীপটি দখল করে কাজকর্ম শুরু করলো তার নাম সন্দ্বীপ, (সেটি এখনও আছে) এখানে মূলত জাহাজ নির্মাণ, মেরামত এবং নুন তৈরি শুরু করা হল। আর সেই নুন জাহাজে করে পাড়ি দিত ইউরোপে।

সুন্দরবনকে ডানপাশে রেখে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে জলপথে পশ্চিমে এলে পড়ে অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর। তখনও ব্রিটিশরা বাংলায় আসেনি আর পাকাপোক্ত খেজুরি বন্দরও তখন তৈরি হয়নি। হুগলি নদী ও বঙ্গোপসাগরের মিলন স্থলে প্রায় ১০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে একটি দ্বীপ ছিল, সেটিও দখল করে কেল্লা বানিয়ে ফেলে একাংশ ফিরিঙ্গি বণিক। ভৌগলিক ভাবে এই দুটি জায়গা দখল করার পর তারা হয়ে উঠেছিল অনেক শক্তিশালী।

বাণিজ্যের স্বার্থে দেশ বিদেশে পাড়ি দিতেই হত, ফলে জলযানই ছিলই তাদের অন্যতম অস্ত্র। বঙ্গোপসাগরের প্রধান দুটি স্থলকে আয়ত্বে আনার পরেই তারা এ অঞ্চলের অঘোষিত রাজা হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বাংলায় নবাবী আমলে স্থানীয় রাজার পরাজয়ের পর, আরাকানে এক নতুন সাম্রজ্যের উদ্ভব হল। ম্রায়ুক উ সাম্রাজ্য।

আর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে পর্তুগিজরা। যদিও যুদ্ধে হেরে সন্ধির পথ নেয় ফিরিঙ্গি সেনা। এর পরেই তারা আরাকানের রাজাকে বুদ্ধি দেয়, তারা কেন মুঘলদের কর দিতে যাবে। বরং হাত মেলালে একটা বড় অংশ তাদের দখলে থাকবে আর মুঘলদের থেকেই তারা কর আদায় করতে পারবো। রাজা রাজি হল, তৈরি হল মগসেনা। মগ জলদস্যুর সেনা।

চট্টগ্রাম লাগোয়া সন্দ্বীপ নামের দ্বীপ, হুগলি নদীর ও সাগর লাগোয় খেজুরির কাছের একটি দ্বীপ তাদের হাতে, ফলে পুরো হুগলি নদীর আসা যাওয়ার পথে প্রায় কুম্ভকর্ণের মতো পাহারাদার তারা। আর পূর্ব মেদিনীপুর লাগোয়া দ্বীপের নাম হল, ইলে দা মরচে। অর্থাত মৃত্যুর দ্বীপ। সন্দ্বীপ তৈরি হয়েছিল বাণিজ্যের জন্য ও সীমাসুরক্ষার জন্য। আর মৃত্যুর দ্বীপে কেল্লা নির্মাণ হল বঙ্গোপসাগরের বুকে এক কালো ইতিহাস রচনার লক্ষ্যে।

দ্বীপটি ছিল, নাঙলের আকৃতির প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার। জলদস্যুদের হল্ট স্টেশন, বাংলা, উড়িষ্যার পুরুষ ও মহিলাদের তুলে এনে বন্দি করে রাখা হত। কিছু রাখা হত নিজেদের মনোরঞ্চনের জন্য। কিছুজন বিদেশে বিক্রি করা হত, ক্রীতদাস হিসেবে।

ছবিতে ক্লিক করলেই সরাসরি গ্রুপে

ফুলে ফেঁপে উঠল আরাকান সাম্রাজ্য ও পর্তুগিজ বণিকদের একটি দল। যদিও নাম কুড়িয়ে নিল মগ জলদস্যু। বাংলা উড়িষ্যা উপকুল জুড়ে এদের তাণ্ডব চলতে থাকলো। আক্ষরিক ভাবে হয়ে উঠলো মগেদের মুক্তাঞ্চল।

এবার খুব ছোট করে আসি এই মৃত্যু দ্বীপের কথায়। এই দ্বীপের মালিক ছিল সাইমন গনসালভেস। সাক্ষাত শয়তান। সে পাশা খেলতে খুব ভালোবাসতো। সকালে ব্রেকফাস্টে সে ফল খাবে নাকি ব্রেড নেবে সেটাও ঠিক করতো পাশার ঘুঁটি।

সেই ঘুঁটির মান নিজের মতো মিলে গেলে তবেই কাজ। কোন দিকে যাওয়া হবে, কোন গ্রাম লুঠ হবে, সব ঠিক করতো পাশার ঘুঁটি।। তার এক ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল, রিবেরো পারদাল। সে তাদের সেনাকে হিংস্র করার জন্য একটি উপায় বলে সাইমনকে।

আরও পড়ুন- নৃসিংহপুরের রাজবাড়ি কেন ভয়ঙ্কর? কী ঘটে সেখানে?

উপায়টি ছিল, যারা দাসত্বে প্রতিবাদী, মানে বিদ্রোহ করতো তাদের হত্যা করে মাংস রান্না করে খাওয়ানো হত অন্য সেনা ও ক্রিতদাসদের। ধারণা ছিল, তারাও এতে হিংস্র হয়ে উঠবে। পরামর্শ ভালো লাগলো, সঙ্গে পাশার ঘুঁটিও সায় দিল, চালু হল প্রতিবাদীদের হত্যা করে, মাংস খাওয়ার পালা।

সাইমনের পাশার ঘুঁটি ছিল শকুনের হাড় থেকে তৈরি, তাঁকে দিয়েছিলেন লিসবনের একজন ধর্মযাজক। আর এই ঘুঁটির জোরে সে বহুবার সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা পেয়েছ। ফলে তার অগাধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল পাশার ঘুঁটির উপর। সেই ছিল মৃত্যু দ্বীপের সর্বেরসর্বা। সেই দ্বীপের কেল্লায় কিকি ছিল, তার স্থাপত্য কেমন ছিল, বা ঠিক কেমন অপরাধ সংগঠিত হত, তার এক বিস্তারিত ইতিহাস রয়েছে। তাতে যাচ্ছি না।

সেই দ্বীপ দীর্ঘদিন মুঘলদের দখলে আসেনি। কারণ, মুঘলদের স্থলবাহিনী যতটা সবল ছিল, নৌবাহিনী তার প্রায় কিছুই ছিল না। এবার পর্তুগিজদের টাইট দিতে মুঘল সম্রাট শাজাহান হুগলির সাতগাঁ থেকে পাততাড়ি গোটানোর নির্দেশ দেয়। পর্তুগিজদের একাংশ বণিক ভালো হলেও, তারাও ছিল জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে, ফলে তাদের হ্যাঁ, না ছাড়া নড়ার উপায় ছিল না। জলদস্যুরা সম্রাটকে পাত্তাই দিত না।

অবশেষে ঔরঙ্গজেবের আমলে ১৬৬৬ সালে বাংলার সুবেদার করে পাঠানো হল শায়েস্তা খাঁকে। তার আগে ১৬৬০ সাল নাগাদ সেই সময় ঔরঙ্গজেবের দাপটে এই আরাকান সম্রাটের কাছে আশ্রয় নেন শাহ সুজা (ঔরঙ্গজেবের ভাই)। আরাকান সেনার সঙ্গে ও জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই হল।

দখল নেওয়া হল চট্টগ্রাম। গুঁড়িয়ে দেওয়া হল ইলে দা মরচে। চট্টগ্রাম মুঘলদের দখলে এলো। যদিও আরাকান সাম্রাজ্য ম্রাউক উ সম্রাটের অধীনেই থাকলো। কয়েক বছর পর, ধীরে ধীরে সাগরের তলায় ডুবে গেল ইলে দা মরচে দ্বীপ। সাগর গিলে নিল এক কালো ইতিহাসকে।

https://www.youtube.com/watch?v=m5xtut6gOgk
Travel Tv Bangla on Youtube Subscribe our channel

ফিচার ইমেজ প্রতীকি

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

নিজস্ব ইতিহাস হারিয়ে বাঙালির কাছে কেন হয়ে উঠল ‘গ্রান্ড ক্যানিয়ন অফ বেঙ্গল’

স্বাতী চট্টোপাধ্যায়ঃ– আমাদের মতো সস্তা শহুরে বাঙালিদের ফ্যান্টাসি অসাধারণ। বিশ্ব দরবারে বাঙালি শ্রেষ্ঠ হলেও, ইংরেজ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!