স্বাতী চ্যাটার্জি- ভূস্বর্গ কাশ্মীর, মুঘল সম্রাট এই উপত্যকা দেখার পর বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে কিছু তা হলে সেটা এখানেই আছে। তারপর মুঘল সম্রাট শাহজাহান থেকে ঔরঙ্গজেব প্রত্যেকেরই পছন্দের জায়গা ছিল কাশ্মীর। তারপর ইংরেজদের কাছেও এই জায়গা ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে এতটাই বিপুল ও বৈচিত্র্যে ভরা না চাক্ষুষ করলে বিশ্বাস করা যায় না। ভারতের যতগুলি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা হল কাশ্মীর। গত কয়েক দশক ধরে, সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কাশ্মীর, তা সত্ত্বেও জনপ্রিয়তা এতটুকু হ্রাস হয়নি। এখানকার হ্রদ, পাহাড়, বরফ, উপত্যকা, ফল ও ফুলের বাগান, সবুজ মাঠ, বার্চ এবং উইলো গাছের জঙ্গল বরাবরই ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণ করে এসেছে। শ্রীনগর, গুলমার্গ, সোনমার্গ, পহেলগাঁও, অনন্তনাগ সৌন্দর্য্য অবর্ণনীয়। এখানকার প্রকৃতিক সৌন্দর্যই শুধু নয়। কাশ্মীরের একটা লম্বা ইতিহাসও রয়েছে। প্রায় হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এখনও বেঁচে রয়েছে।
অনেকেই কাশ্মীর বেড়াতে যান পরিচিত কয়েকটি জায়গায়, যেমন শ্রীনগর, গুলমার্গ, সোনমার্ক, পেহেলগাঁও কেউবা গিয়ে থাকেন পাটনিটপ পর্যন্ত। কিন্তু এ ছাড়াও প্রাকৃতির বৈচিত্র্যে ভরপুর এমন বেশ কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে পর্যটকেরা সেই দিকগুলি ঘুরেও দেখেন না। তেমন কয়েকটি অফবিট জায়গার হদিশ দিলাম আমরা।
ইউসমার্গ
রাজধানী শ্রীনগর প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ইউসমার্গ। এই শব্দের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় যিশুর তৃণভূমি। স্থানীয় একাংশ নাগরিকদের বিশ্বাস একটা সময় কাশ্মীরে এসেছিলেন যিশু। তিনি এখানেই মারা যান, তাঁর একটি কবরও রয়েছে শ্রীনগরের কাছে একটি জায়গায়। কাশ্মীর পশ্চিমে অবস্থিত এই শৈল শহরে পর্যটকদের ভিড় অনেকটাই কম। এখানকার তৃণভূমি, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাইন গাছের জঙ্গল মনকে মুগ্ধ করে দেয়। উপত্যাকায় দেখা যায় ছোটো ছোটো ঝরনা।
এখানকার আপেল এবং পুদিনার খেতও দর্শনীয় জায়গা। এখানকার পরিবেশ ও আবহাওয়া অনেকটাই ইউরোপের কয়েকটি দেশের মতে। ইউসমার্গ শহরের একদিকে বয়ে গেছে শতদ্রু নদীর শাখা দুধগঙ্গা। পীরপঞ্জাল পর্বেত কোলে গড়ে ওঠা ইউসমার্গ নগর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে। এখানকার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত অসাধারণ সুন্দর।
অরু ভ্যালি
অনন্তনাগ জেলায় অন্যতম জনপ্রিয় অফবিট জায়গা হল অরু ভ্যালি। পেহেলগাঁও থেকে অরু ভ্যালির দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার। এই উপত্যকা থেকে লিডার নদীর দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। বরফে চাদরে মোড়া একাধিক পর্বত শৃঙ্গ, পাহাড়ি ঝরনা, হ্রদ আর সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। লিডারওয়াত, বিশনসর-কিশনসর এবং কঙ্গনের বেস ক্যাম্পও আয়োজন করা হয় এখানে। কোলহোই কাশ্মীর উপত্যকার বৃহত্তম হিমবাহ। কাশ্মীরের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট কোলাহোই-এর কাছেই অবস্থিত। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মাউন্টেনিয়ার্সদের প্রিয় জায়গায়। অরু উপত্যকাটি রয়েছে অরু নদীর তীরেই। এটি লিডারের একটি শাখা নদী।
গুরেজ উপত্যকা
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪০০ মিটার উঁচুতে রয়েছে, কাশ্মীরের আর এক অনন্য সুন্দর গ্রাম গুরেজ। বন্দিপুর থেকে গুরেজ উপত্যকার দূরত্ব প্রায় ৮৬ কিলোমিটার এবং শ্রীনগর থেকে প্রায় ১২৩ কিলোমিটার উত্তরে। গোটা গ্রামটাই বরফে ঢেকে যায়, ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে কৃষ্ণগঙ্গা নদী। এখানকার জঙ্গলে দেখা যায় স্নো লেপার্ড এবং বাদামি ভাল্লুকের।
কাশ্মীরের অন্যতম জনপ্রিয় সেরা পর্যটনস্থল গুরেজ উপত্যকা। যদিও পর্যটকদের ভিড় সে ভাবে হয় না। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়। এখানকার রাজদান পাস বরফে পুরোপুরি ঢেকে যায়। ফলে সেই সময় গ্রামে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। মোটামুটি জুন মাস থেকে এখানকার রাস্তাঘাট স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
লোলাব ভ্যালি
কাশ্মীরের যতগুলি অফবিট জায়গা রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম উপত্যকা হল লোলাব। এখানকার আপেল, আখরোট, পিচ, চেরি এবং অর্কিডের বাগান মনোমুগ্ধকর।পাহাড়ি হ্রদ, প্রস্রবণ, ধান খেতের দৃশ্যও অসাধারণ। লোলাব উপত্যকা গড়ে উঠেছে কালারুস, পোতনাই এবং ব্রুনাই নামের তিনটি উপত্যকার মিশ্রণে। এখানকার লাহওয়াই নদীর তীর অন্যতম একটি আকর্ষণীয় জায়গা।
লোলাব থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে লালপুর গ্রাম। এখানে নাকি বাস করতেন মহর্ষি কাশ্যপ। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি তীর্থক্ষেত্র হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে। গ্রামটি বেশ নিরিবিলি। লোলাব উপত্যকার গেলে অবশ্যই দেখে নিতে পারেন লাভনাগ এবং গৌরী প্রস্রবণ। এর সৌন্দর্য্য অবর্ণনীয়। লোলাব উপত্যকার ঘন অরণ্যে দেখা মেলে কালো ভাল্লুক, স্নো লেপার্ড, বুনো ছাগল, কাশ্মীরী হরিণের।
তুলেইল ভ্যালি
কাশ্মীরের ভিন্ন স্বাদের অফবিট ডেস্টিনেশন হল তুলেইল উপত্যকা। গুরেজ থেকে এর দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাই যেদিন গুরেজ বেড়ানোর প্ল্যান থাকবে, সেদিনই তুলেইল উপত্যকা ঘুরে নেওয়া যায়। গুরেজ উপত্যকার নীচেই এই এলাকার অবস্থান। এখানে পৌঁছতে গেলে গুরেজ থেকে বরনাই, চকওয়ালি, কাশপত, জারগাই পেরিয়ে যেতে হবে। গ্রামটি দৃশ্য একদম ছবির মতো।
আরও পড়ুন- এখানের প্রথম তৈরি হয়েছিল মুমতাজের তাজমহল
গ্রীষ্মকালে এই উপত্যকায় নানা বাহারি ফুল দেখা যায়, আর এই সময়টি ফটোগ্রাফারদের জন্য আদর্শ সময়। এখানকার নদীতে ভালো ট্রাউট মাছ পাওয়া যায়। তলেইল গ্রামটি যেহেতু লাইন অফ কন্ট্রোল এলাকায় অবস্থিত। তাই এখানে যেতে ভারতীয় সেনার বিশেষ অনুমতি লাগে। দাওয়ার পুলিশ স্টেশন থেকে এই গ্রামে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়। তুলেইল ঘোরার সেরা সময় গ্রীষ্মকাল।
নিত্যনতুন জায়গায় বেড়ানোর জায়গা পেতে এবং আমাদের সঙ্গে
বেড়াতে যুক্ত হয়ে যান, আমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে