তেজপুর বমডিলা তাওয়াং দিরাং ভালুকপং
পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- গুয়াহাটি থেকে সুপারফাস্ট লাক্সারি কোচে সরাসরি বোমডিলা পৌঁছনো যায়। দূরত্ব ৩৪২ কিমি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো পর্যটকের সংখ্যা যদি দু তিনজন হয়, বাসে বা শেয়ারের টাটা সুমোয় অনায়াসে অরুণাচল ভ্রমণ সম্পন্ন হতে পারে। পর্যটকের সংখ্যা যদি সাত আট জন হয়, তাহলে সবচেয়ে ভালো প্রথমে গুয়াহাটি থেকে বাসে ১৮১ কিমি দূরে তেজপুরে পৌঁছনো। সেখান থেকে কয়েক দিনের জন্য একটা সুমো ভাড়া করে বেরোনো ভালো।
তেজপুর থেকে অসম অরুণাচল সীমান্তে অবস্থিত ভালুকপঙের দূরত্ব ৬০ কিমি। ভালুকপং প্রকৃতিক শোভামণ্ডিত অসাধারণ সুন্দর জায়গা। ভালুকপঙে অবশ্যই একরাত থাকতে পারেন। তবে যাওয়ার পথে নয়, ফেরার পথে, ভালুকপং থেকে ৫ কিমি এগোলে টিপি অর্কিড সেন্টার নানা দুর্লভ প্রজাতির মনোমুগ্ধকর অর্কিডের দেখা মিলবে এই বিখ্যাত অর্কিড রিসার্চ সেন্টারে।
টিপি ছাড়িয়ে পথ আরও উঁচুতে উঠতে আরম্ভ করবে, পথ সংলগ্ন বনানী একসময়ে ঘন অরণ্যের রূপ ধারণ করবে। চোখে পড়বে রাক্ষুসে ফার্ন, বুনো কলাগাছ বাঁশ বন আর মোটা শ্যওলায় ঢাকা বিশাল আকার বনস্পতিদের। মাঝে মধ্যে মেঘ ও কুয়াশার লুকোচুরি। এই অবস্থায় গাড়ি পৌঁছবে জিরো পয়েন্টে। পথ এখানে দু ভাগ হয়ে গিয়েছে, ডানদিকের পথ সোজা চলে গিয়েছে পূর্ব কামেং জেলার সদর শেপ্পা শহরে। আর সোজা পথটি নাগমন্দির, রূপা, টেঙ্গা ভ্যালি হয়ে যাচ্ছে ৮২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বমডিলায়।
বমডিলা- শৈল শহর বোমডিলা যেন মেঘের দেশ। একটু বেলা হলেই মেঘেরা এসে শহরের দখল নেয়। তারপর সারাদিন কখনও হাল্কা বৃষ্টি, কখনওবা কিছুক্ষণের জন্য মেঘের অবগুন্ঠন সরে গিয়ে সূর্যের দেখা মেলে। বমডিলা শহরের প্রধান দ্রষ্টব্য হল, দুটি গুম্ফা। একটি প্রাচীন অন্যটি নবীন। পুরোনো গুম্ফাটির অবস্থান বাজার এলাকায় যা লোয়ার মনাস্ট্রি নামে পরিচিত। ফুলের বাগানে ঘেরা এই বৌদ্ধ মন্দিরে অবশ্যই কিছুটা সময় কাটাতে পারেন।
লোয়ার মনাস্ট্রির অদূরে রয়েছে ক্রাফ্ট সেন্টার। পশ্চিম কামেং জেলার অধিবাসী মনপা, শেরদুকপেন, আকা এবং মিজিউপজাতীয় কারিগরদের দক্ষ হাতে তৈরি রকমারি হস্তশিল্প সামগ্রী দেখে অবাক হতে হয়। বমডিলার লোকসংস্কৃতির মিউজিয়ামটিও কম আকর্ষণীয় নয়। বমডিলার আপার মনাস্ট্রির অবস্থান পাহাড়ের প্রায় মাথায়। পায়ে হেঁটে উঠতে একটু কষ্ট হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু উপরে ওঠার পর গুম্ফা এবং চারপাশের দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে পরিশ্রম সার্থক।
বমডিলা শহরের কাছেই গড়ে উঠেছে তিব্বতী শরণার্থীদের বসতি তেনজিং গ্যাং। অনেকের হয়তো জানা নেই বমডিলার কাছে পীঠে রয়েছে অনেক আপালের বাগান। এই আপেল স্বাদে কাশ্মীর বা হিমাচলের আপেলের থেকে কোনও অংশে কম নয়।
বমডিলায় কোথায় থাকবেন- সরকারি ট্যুরিস্ট লজের পজিশন সবথেকে ভালো। বমডিলার সবচেয়ে ভালো হোটেল হল সিফিয়াং কং এছাড়া হোটেল হোটেল সেপাল ইয়াংজং, পানচেন লজ, হোটেল সাংগ্রিলা, হোটেল পাশাং, হোটেল লা, হোটেল পাইনরিজ।
দিরাং- তাওয়াং যাওয়ার পথে বমডিলা থেকে ৪২ কিমি দূরে প্রশস্ত নদী উপত্যকার ধারে ছোট শহর দিরাং। প্রকৃতিক শোভায় ভরা দিরাঙের উচ্চতা প্রায় ৫৫০০ ফুট। শহরের কাছেপিঠে রয়েছে আপেল ও ন্যাস্পাতির বাগান। দিরাঙের অন্য দ্রষ্টব্য হল ইয়াক রিসার্চ সেন্টার। ভেড়া প্রজনন কেন্দ্র আর উষ্ণ প্রস্রবন। দিরাঙের শান্তশ্রী এবং অনুপম নিসর্গের আকর্ষণে বহু পর্যটক দিরাঙে রাত্রিবাস করতে চান। দিরাঙে রাত্রিবাসের জন্য রয়েছে ট্যুরিস্ট লজ এবং হোটেল পেমালিং, মা লক্ষ্মী লজ।
তাওয়াং- দিরাং থেকে ৪০ কিমি এগিয়ে অতিক্রম করতে হবে ১৩৭২১ ফুট উঁচু বিখ্যাত সেলাপাস। আবহাওয়া ভালো থাকলে যাত্রাপথের দৃশ্য দেখে অভিভূত হতে হবে। চলার পথে চোখে পড়বে একের পর এক সেনা শিবির এবং সীমান্ত সড়ক নির্মাণ সংস্থার ক্যাম্প। সেলাপাসের উপর দাঁড়িয়ে চারপাশের বরফে ঢাকা চারপাশের দৃশ্য চমকপ্রদ। গিরিপথের উপরে রয়েছে দেবমন্দির। সেলাপাস অতিক্রম করলে সেলালেকের দর্শন মিলবে। উতরাই পথ ধরে নেমে আসার পথে গাড়ি দাঁড়াবে যশবন্ত গড়। এখানে রয়েছে বীর সৈনিক যশোবন্তসিং রাওয়াতের স্মৃতি মন্দির। ১৯৬২ সালের চিনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ইনি সিংহ বিক্রমে যুদ্ধ করে নিজের প্রাণের বিনিময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনা চৌকি আগলে রেখেছিলেন।
যশোবন্তগড় থেকে রওনা দিয়ে গাড়ি পৌঁছবে জং নামের ছোট্ট গ্রামে। এখানে বিহারী ময়রার দোকানের গরম কচুরি ও চা পান সেরে শুরু করুন পথ চলা। তাওয়াং যাওয়ার পথে নুরানাং জলপ্রপাতের কাছে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিন। অপূর্ব লাগবে। ভারতের সবচেয়ে সুন্দর শৈল শহরগুলির অন্যতম এই তাওয়াং। ১০২০০ ফুট উঁচু তাওয়াঙের প্রধান আকর্ষণ ৪০০ বছরের প্রচীন বৌদ্ধ মঠ যা তাওয়াং মনাস্ট্রি নামে বিখ্যাত। প্রায় ৫০০ লামা এখানে স্থায়ী বাবে বাস করেন। অনেকের মতো তিব্বতের বাইরে এতো বড় মঠ আর নেই। এক সময় তাওয়ার অঞ্চল শাসন করতেন লাসার দ্বারা নিযুক্ত প্রতিনিধিরা। ৩৭০ বছর আগে তাওয়াং এলাকার প্রধান অধিবাসী মনপাদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করেন মেরে লামা বা মিরিক লামা নামে এক বৌদ্ধ গুরু।
তাওয়াং গুম্ফার পরিসরে আজও তাঁর সমাধি সংরক্ষিত আছে। তাওয়াং মঠ হাতে সময় নিয়ে দেখুন। মঠের প্রধান বুদ্ধ মন্দিরে রয়েছে ২৬ ফুট উঁচু বুদ্ধ মূর্তি। মন্দিরের বাইরে ও ভেতরের দেওয়ালে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করে আঁকা আছে বুদ্ধের জীবনি সম্পর্কিত নানা ঘটনার ছবি। তাওয়াং মঠের মিউজিয়ামে প্রদর্শিত সামগ্রী বৈচিত্র্যে ও ঐতিহাসিক মূল্যে অতুলনীয়। এখানে সযত্নে রক্ষিত আছে প্রচীন পুঁথির সংগ্রহ, থাংকা, কয়েকশো বছরের পুরনো বাসনপত্র, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, বিরাট আকারের তালাচাবি, কাঠের মুখোশ, ধাতু নির্মিত বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের মূর্তি এবং আরও কত কী! এই মিউজিয়ামের অন্যতম সম্পদ হল ৩০০ বছরের পুরনো দুটি বিশালাকার হাতির দাঁত। তাওয়াং মঠের চত্বর থেকে তাওয়াং শহরের দৃশ্য এবং দূরের নদী উপত্যকার শোভা মনোমুগ্ধকর। তাওয়াঙের আকাশে কিছুক্ষণ পর পরেই হেলিকপ্টারের ওঠানামা চোখে পড়ে। এই হেলিকপ্টারের সাহায্যে চিন সীমান্তে অবস্থিত সেনা শিবিরে রসদ ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো হয়।
তাওয়াং মঠের কাছে রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুনীদের আন্নি গুম্ফা, পুরুষ দর্শনার্থীরাও ওই গুম্ফায় যেতে পারেন। তাওয়াঙের ক্রাফ্ট সেন্টারে জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা, ছেলেমেয়েদের নানারকম হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর কাছেই রয়েছে অরুণাচল সরকারের সেল্স এম্পোরিয়াম। ভিতরে ঢুকলে প্রায় সব কিছুই কিনতে ইচ্ছে যাবে। তাওয়াঙে আরও একটি দ্রষ্টব্য হল ১৯৬২ সালের যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত ওয়ার মেমোরিয়াল।
তাওয়াং থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসা যায়, ১৬ কিমি দূরে পিতিশো লেক এবং আরও দূরে অবস্থিত সাংঙ্গেস্টার লেক।
কোথায় থাকবেন- সবচেয়ে ভালো হয়, সরকারি ট্যুরিস্ট লজ এখানে খাবার ব্যবস্থাও রয়েছে। অন্য হোটেলগুলি হল, মনইউল লজ, হোটেল তাওয়াং ভিউ, তাওয়াং ইন, হোটেল বুদ্ধ, হোটেল প্যারাডাইস, হোটেল গোরিচেন, হোটেল সামদ্রুপলিং, হোটেল নেফা, হোটেল রেনবো।
নানা অফবিট জায়গায় বেড়ানো ও আড্ডা দিতে আজই যোগ দিন আমাদের গ্রুপে ভ্রমণ আড্ডা
ভালুকপং- অরুণাচল ভ্রমণ শেষ করে ভালুকপং যাওয়ার একটি বিশেষ কারণ হল, যারা গাড়ি ভাড়া করে অরুণাচল বেড়াবেন তারা স্বচ্ছন্দে ভালুকপং পৌঁছে ভাড়া গাড়ি ছেড়ে দিতে পারেন। যাঁরা বাসে বা শেয়ারের সুমো চেপে তাওয়াং থেকে ফিরবেন তাঁরাও নিশ্চিন্তে ভালুকপঙে নেমে যেতে পারেন। ভালুকপং থেকে কিছুক্ষণ পরপর তেজপুর যাওয়ার বাস, মিনিবাস এবং শেয়ারের টাটা সুমো ছাড়ছে দূরত্ব ৬০ কিমি। তেজপুর থেকে গুয়াহাটি যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার। ভালুকপঙের প্রকৃতিক শোভার তুলনা মেলা ভার অরুণাচলের পাহাড় থেকে নেমে এসে কামেং নদী ভালুকপঙে জিয়াভরালি নাম পেয়েছে। নদী পাহাড় আর সবুজ জঙ্গল মিলে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যপট রচনা করেছে। অসম পর্যটন দফতরের ট্যুরিস্ট লডের দোতলার বারান্দায় বসেই কেটে যাবে সময়।
কোথায় থাকবেন- অসম পর্যটন দফতরের ট্যুরিস্ট লজ, ভালুকপং ট্যুরিস্ট লজ, কুনকি রিসর্ট, তেজপুর শহরে রাত্রিবাস করতে চাইলে সবচেয়ে ভালো হয় সরকারি ট্যুরিস্ট লজ। অন্য কয়েকটি হোটেল- মেঘদূত, হোটেল ল্যুইথ, হোটেল পারিজাত, কন্যা কন্যাপুর।