পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- মিজোরাম সম্পর্কিত এক এবং অদ্বিতীয় তথ্য হল, অপরূপ প্রকৃতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। বহু বছর ধরেই উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যকে নিয়ে যেমন পূর্বতন কেন্দ্র সরকারের অনীহা ছিল, তেমন বাঙালিদেরও এই রাজ্যগুলি সফরের একটা অনীহা রয়েছে। তার অন্যতম কারণ, পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, এবং স্বচ্ছ ধারণা না থাকা।
একটা সময় ছিল মিজোরামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত অশান্ত। ১৯৮৬ সালের জুন মাসে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে এক শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় ভারত সরকারের। তারপর থেকে সবচেয়ে শান্ত রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায় মিজোরাম।
আজ যাকে মিজোরাম বলে চেনে সবাই, এক সময় এটাই ছিল লুসাই পাহাড়। এই পার্বত্য অঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দা হল, লুসাই উপজাতির। এ ছাড়া অন্য যে সমস্ত উপজাতিরা রয়েছে তারা হল লাখের, মার, রালতি, চাকমা ও পাওই। সব থেকে ইন্টেরেস্টিং পয়েন্ট হচ্ছে, রাজ্যের নাম হয়েছে মিজোরাম অথচ মিজো নামে কোনও উপজাতি নেই। লুসাই পাহাড়ের বাসিন্দারা সমতলের বাসিন্দাদের মিজো বলে ডাকত। শব্দটি মূল অর্থ উঁচু জায়গায় বাস করে যারা। বর্তমানে মিজোরামের বাসিন্দারাই মিজো নামে পরিচিত হয়েছে।
মিজোরামের ইতিহাস কিছুটা ধোঁয়াশাছন্ন। এক অংশ গবেষকদের মত, প্রায় তিনশো বছর আগে, পশ্চিম মায়ানমার থেকে লুসাইদের পূর্বপুরুষেরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। সেই সময় উপজাতিদের সমাজ শাসিত হত প্রবল ক্ষমতাধর গোষ্ঠীপতিদের দ্বারা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লুসাইরা সমতলের বিভিন্ন জনপদ ও চা বাগানে হামলা চালাতে থাকে। সেই সময় ব্রিটিশদের শাসন কৌশল তাদের দমন করতে সক্ষম হয়। অবশেষে ১৮৯১ সালে লুসাই পাহাড়ের অধিকাংশ জায়গা ব্রিটিশদের দখলে আসে। ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে লুসাই পার্বত্য জেলা বলে অসমের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এই সময় থেকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রভাব বাড়তে থাকে। লুসাইয়ের অধিবাসীরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। বর্তমানে মিজোরামের ৭৫ শতাংশই খ্রিস্টান । এরপর দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালে লুসাই পার্বত্য জেলাকে অসম থেকে বের করে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লুসাই পার্বত্য জেলার নতুন নাম দেওয়া হল মিজোরাম। ১৯৮৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি মিজোরাম পৃথক রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রথম থেকে ই খ্রিস্টান মিশনারিরা শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে মিজোরামে শিক্ষিতের হার বেশি। শিলচর শহর থেকে রাওনা দিয়ে মিজোরামে প্রবেশ করতে হয় ভাইরেংতে চেক পোস্ট দিয়ে। এখানে বহিরাগত যাত্রীদের ইনারলাইন পারমিট পরীক্ষা করা হয়। এখান থেকে আইজল যাওয়ার পথ হাল্কা চড়াই। সেই পথে পড়বে একাধিক পাহাড়। এই সব পাহাড়ি পথে পাইন দেবদারুর বদলে বেশি চোখে পড়বে বাঁশবন।
মিজোরামে বাঁশের জঙ্গল বেশ বিখ্যাত। মিজোদের বসতি, প্রাত্যহিক জীবন খাদ্যভ্যাস, হস্তশিল্প প্রায় সব কিছুতেই জড়িয়ে রয়েছে বাঁশের ব্যবহার। লুসাইদের বিখ্যাত লোকনৃত্য চেরোতেও বাঁশের লাঠির অদ্ভুত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
শিলচর থেকে আইজল যাওয়ার পথে চোখে পড়বে ছোট বড় বেশ কিছু জনপদ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শহর কোলাসিব। আইজলে প্রবেশ করার আগেই দূর থেকে এই শৈল শহরের বিস্তার পর্যটকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আয়তনের দিক থেকে বিচার করলে ভারতের বৃহত্তম পাহাড়ি শহরগুলির মধ্যে অন্যতম আইজল।
আইজল শহরের বৈচিত্র্য হচ্ছে খুব ভোরেই শুরু হয়ে যায় এখানকার জীবনযাত্রা। বেলা যত গড়ায়, বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। সূর্য পশ্চিমদিকে ঢোলে পড়তেই, ফাঁকা হতে শুরু করে রাজপথ থেকে গলি। আর যখন পুরো অন্ধকার নেমে আসে, তখন গোটা শহর যেন গভীর ঘুমে। সন্ধে হলেই দোকানপাট বন্ধ। এই একটা কারণেই আইজল শহর দেখে নিতে হবে বিকেলের মধ্যে।
কিছু পর্যটকদের নজরে আইজল শহরে দেখার জায়গা হাতে গোনা। কিন্তু ভালো করে দেখতে গেলে পুরো শহরটার একটা স্বতন্ত্র রূপ রয়েছে। ৩৯১৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আইজল শহরকে বলা হয়, লুসাই পাহাড়ের হার্ট। শহরটাকে দেখতে হলে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাই ভালো, এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে। সময় পেলে আইজল বাজারে ঘুরে নিন। স্থানীয়দের পসরা, পণ্য ভাণ্ডার দেখে অবাক হতে হয়।
ভোর বেলা আইজলের ভার্টলং পাহাড় থেকে চোখে পড়বে শহরের মনোরম দৃশ্য। দূরে পাহাড়ের কোলে মেঘের খেলা। ভার্টলং পাহাড়েই রয়েছে একটি ছোট চিড়িয়াখানা। এখানে মিজোরামের কিছু বিরল প্রাণীর দর্শন মেলে। পাশাপাশি দেখে নিন, আইজলের ম্যাকডোনাল্ড পাহাড়ে অবস্থিত মিজোরাম স্টেট মিউজিয়াম। এখানে দর্শনীয় সামগ্রী দেখতে খারাপ লাগে না।
আরও পড়ুন- রাজস্থান সার্কিট সফরে দেখে নেওয়া রাজপুতদের রাজকাহানি
আইজলের আরও একটি দর্শনীয় জায়গা হল, লুয়াংমুয়াল হস্তশিল্পকেন্দ্র। বাঁশ এবং বেতের তৈরি নানা হস্তশিল্পসামগ্রী কীভাবে তৈরি হয়, তা নিজের চোখে দেখে নিতে পারবেন।
মিজোরামের লোক সংস্কৃতি ও লোক উত্সব দেখার মতো। এদের মার্চ মাসে একটি বসন্ত উত্সব হয়। অগস্ট-সেপ্টেম্বরে মিমরুট এবং নভেম্বর ডিসেম্বরে পলকুট। লুসাই ভাষায় কুট শব্দের অর্থ উত্সব। খ্রিস্টান প্রধান মিজোরামে বড়দিনও বেশ ভালো করে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন- কাশ্মীর বা হিমাচল বেড়ানোর প্ল্যান করছেন? ঝালিয়ে নিন দুটো জবরদস্ত প্ল্যান
আইজল শহর থেকে একদিন গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ুন ৮০ কিমি দূরে তামদিল লেক দর্শনে। চাইলে বোটিং করতে পারেন। এ ছাড়া আইজলের কাছে দেখে নিন স্থানীয়দের দুটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট বুং এবং পাইখাই। আইজল থেকে ১৩৭ কিমি দূরে মিজোরামের বিখ্যাত জলপ্রপাত ভ্যানতোয়াং। এই জলপ্রপাতের কাছাকাছি শহর হল থেনজল। দূরত্ব ৭ কিমি। এখানে রয়েছে তাঁতবস্ত্রের কারখানা।
মিজোরাম থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত চাম্ফাই শহর। এতোটা পথ পেরিয়ে আসার পর মনে হবেই, যেন এক ভিন্ন দুনিয়ায় এসে পড়েছি। কারণটা হল, মায়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানে প্রকৃতিক শোভাতো রয়েইছে, সেই সঙ্গে স্থানীয় বাজারে ঘুরলে মনে হবে, ভারতে আছেন না মায়ানমারে। চাম্ফাইকে বলা হয়, মিজোরামের শস্য ভাণ্ডার।
আইজল থেকে ২৩৫ কিমি দক্ষিণে রয়েছে আরও একটি সুন্দর জায়গা লুংলেই। এই জেলা সদরের খ্যাতিও প্রকৃতিক সৌন্দর্য। এখানে সরকারি ট্যুরিস্ট লজ রয়েছে।
আরও পড়ুন- জানুন সেলুলার জেলের ইতিহাস সঙ্গে আন্দামান সফরের প্ল্যান
** এই সাতটি রাজ্য, কখন, কীভাবে পরিকল্পনা করে বেড়াবেন বা একই সফরে দুটি তিনটি রাজ্য কীভাবে ঘুরে নেবেন তার বিস্তারিত ট্যুর প্ল্যান দেওয়া হবে এই সাইটে। ফলে আমাদের সমস্ত আপডেট পেতে টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হতে পারেন। হোয়াটস অ্যাপে পিং করে রাখতে পারেন 9073503958 বা আমাদের ফেসবুকগ্রুপে জয়েন করতে পারেন।