ভূমিকা
হাওড়া জেলার ডোমজুড় থানার অন্তর্গত মাকড়দহ গ্রামে অবস্থিত মাকড়চণ্ডী মন্দির বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও জাগ্রত দেবী মন্দির হিসেবে সুপরিচিত। দেবী মাকড়চণ্ডীর নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ হয়েছে মাকড়দহ। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা, স্থাপত্য ও লোককাহিনী বাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন করে।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস
প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি অনুসারে, একসময় সরস্বতী নদী ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হয়ে মন্দিরের কাছে এসে পূর্বদিকে প্রবাহিত হতো। সেই সময় জনৈক শ্রীমন্ত সওদাগর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই স্থানে মন্দির নির্মাণ করেন এবং দেবী মাকড়চণ্ডীর পূজা শুরু করেন। কালের বিবর্তনে সেই মন্দির বিলুপ্ত হলেও, বর্তমান মন্দিরটি প্রায় তিন শতাব্দী আগে নির্মিত হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে আজও তিনটি প্রস্তরখণ্ড ভগ্নস্তূপ হিসেবে বিদ্যমান, যা প্রাচীন মন্দিরের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে।
মন্দিরের স্থাপত্য ও দেবীমূর্তি
বর্তমান মন্দিরটি ১২২৮ বঙ্গাব্দের ৩১ আষাঢ়ে নির্মিত হয়েছিল, যা মৌরীর জমিদার রাধাকান্ত কুণ্ডুচৌধুরীর উদ্যোগে সম্পন্ন হয়। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তি একটি পাথরের খণ্ড, যার মাথায় মুকুট রয়েছে। মূর্তির কপালের নিচে সোনার ভ্রূ ও ত্রিনয়ন, কানের পাশে সোনার অলংকার, এবং নাক ও ঠোঁট সোনার তৈরি। দেবীর গলায় জবা ফুলের মালা থাকে, যা মূর্তির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
ধর্মীয় গুরুত্ব ও পূজারীতি
দেবী মাকড়চণ্ডী অন্নপূর্ণা ও দুর্গার রূপে পূজিত হন। প্রতিদিন ভোরে মঙ্গল আরতি, স্নান ও পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ১২টায় ভোগ নিবেদন করা হয়, যেখানে খিচুড়ি, চচ্চড়ি, তরকারি, পাঁচ রকম ভাজা, মাছ, পরমান্ন ও চাটনি অন্তর্ভুক্ত থাকে। দোল উৎসবের পঞ্চম দিনে বিশেষ পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা ১৫ দিনব্যাপী চলে। এই সময় দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা মন্দিরে সমবেত হন।
লোককাহিনী ও বিশ্বাস
কিংবদন্তি অনুসারে, এক সময় সরস্বতী নদী পথে বাণিজ্যিক তরী চলাচল করত। একজন বণিক স্বপ্নাদেশ পেয়ে সরস্বতী তীরবর্তী বেতের জঙ্গলে পাতাল ফুঁড়ে ওঠা চণ্ডীর মূর্তির পূজা শুরু করেন। দেবীর মূর্তি বিশাল আকৃতির ছিল, যার মাথায় জল ঢাললে তা পুরোহিতের পায়ে পড়ত। পুরোহিতের পাপমোচনের জন্য দেবী মূর্তি পাতালে প্রবেশ করতে শুরু করেন, এবং পুরোহিত মূর্তিকে জড়িয়ে ধরেন। ফলে, মূর্তির অর্ধেক অংশ উপরে জেগে থাকে এবং সেই রূপেই দেবী পূজিত হন।
উপসংহার
মাকড়চণ্ডী মন্দির বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এর প্রাচীনত্ব, স্থাপত্যশৈলী ও লোককাহিনী মন্দিরটিকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্তের সমাগমে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়, যা বাংলার সমৃদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন।
