মারাঠা সাম্রাজ্যের সময়ে এক ঐতিহাসিক কেল্লা কোন্ধানা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বীর তানাজির নাম

কোন্ধানা কেল্লার ইতিহাস

কোন্ধানা কেল্লা (Kondhana Fort), যা পরবর্তীতে সিংগাড় Fort নামে পরিচিত হয়, ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের একটি ঐতিহাসিক দুর্গ। এটি বর্তমানে সিংগাড় দুর্গ (Sinhagad Fort) নামে বেশি পরিচিত। দুর্গটি পুনে শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এবং এটি মারাঠা সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ হিসেবে পরিচিত।

প্রাচীন ইতিহাস

কোন্ধানা কেল্লার নির্মাণের সঠিক সময়কাল অজানা, তবে ধারণা করা হয় এটি ২০০০ বছরেরও পুরনো। ১৩২৮ সালে এটি প্রথমবারের মতো দখল করে দিল্লির তুঘলক রাজবংশের সেনারা। পরবর্তীতে এটি বহু শাসকের হাতে গিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাহামনি সুলতান, মোঘল সাম্রাজ্য, এবং মারাঠা যোদ্ধারা।

শিবাজি মহারাজ ও মারাঠা শাসন

১৬৪৭ সালে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এই দুর্গটি অধিকার করেন, তবে ১৬৬৫ সালে পুরন্দার চুক্তির মাধ্যমে এটি মোঘলদের হাতে চলে যায়। পরবর্তীতে ১৬৭০ সালে মারাঠা সেনাপতি তানাজি মালুসারে দুর্গটি পুনরুদ্ধার করেন।

“গড় আলা, পন সিংগ গেলো” (দুর্গ দখল হয়েছে, কিন্তু সিংহ চলে গেছে) – এই বিখ্যাত উক্তিটি তানাজি মালুসারের বীরত্বের প্রতীক, কারণ তিনি এই যুদ্ধে প্রাণ হারান। এরপর শিবাজি মহারাজ দুর্গের নাম পরিবর্তন করে “সিংগাড়” রাখেন।

আধুনিক যুগে গুরুত্ব

ব্রিটিশ আমলেও এই দুর্গ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং ১৮১৮ সালে এটি ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।

বর্তমানে এটি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।

পুরন্দর চুক্তি (Treaty of Purandar) – 1665

পুরন্দর চুক্তি হল ১৬৬৫ সালে মারাঠা নেতা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সেনাপতি রাজপুত জেনারেল জয়সিংহ (Raja Jai Singh I of Amber)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি।

চুক্তির কারণ

১৬৬০-এর দশকে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে বাধা দিতে চেয়েছিলেন। শিবাজি মহারাজ তখন মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন এবং মুঘল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাচ্ছিলেন।

মুঘলদের আক্রমণ

১৬৬৫ সালে রাজা জয়সিংহ ও দীলের খান বিশাল এক মুঘল বাহিনী নিয়ে শিবাজির দুর্গ ও এলাকা আক্রমণ করেন।

পুরন্দর দুর্গ মারাঠাদের গুরুত্বপূর্ণ দুর্গগুলোর মধ্যে একটি ছিল।

দীর্ঘ অবরোধের পর শিবাজি বুঝতে পারেন যে সরাসরি প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।

এর ফলে শিবাজি কূটনৈতিকভাবে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হন, যা ইতিহাসে পুরন্দর চুক্তি (Treaty of Purandar – 1665) নামে পরিচিত।

পুরন্দর চুক্তির শর্তাবলি

১. মারাঠারা ২৩টি দুর্গ মুঘলদের কাছে সমর্পণ করবে – শিবাজি তার মোট ৩৫টি দুর্গের মধ্যে ২৩টি মুঘলদের হাতে তুলে দেন এবং কেবলমাত্র ১২টি দুর্গ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।

২. ৩ লক্ষ হোণ (মুদ্রা) কর দেওয়া – শিবাজি মুঘলদের বার্ষিক কর দেওয়ার শর্তে রাজি হন।

৩. শিবাজি ও মুঘল সম্পর্ক – শিবাজি মুঘলদের অধীনে থাকবেন এবং ভবিষ্যতে কোনো বিদ্রোহ করবেন না।

৪. শিবাজির পুত্র সম্ভাজির মুঘল সেনায় যোগদান – শিবাজির ছেলে সম্ভাজিকে মুঘল বাহিনীর অধীনে রাখা হয়।

পুরন্দর চুক্তির ফলাফল

চুক্তির পর শিবাজি সাময়িকভাবে মুঘলদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন, তবে তিনি পুরোপুরি তাদের অধীনতা মেনে নেননি।

১৬৬৬ সালে শিবাজিকে ঔরঙ্গজেব আগ্রা দুর্গে বন্দি করেন, কিন্তু তিনি সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে আসেন।

চুক্তির কয়েক বছর পর শিবাজি আবার মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তার অধিকৃত দুর্গগুলি পুনরুদ্ধার করেন।

উপসংহার

পুরন্দর চুক্তি ছিল শিবাজির জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে এটি মারাঠাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়, কিন্তু ভবিষ্যতে শিবাজি নতুন শক্তি সঞ্চয় করে আরও বড় বিজয় অর্জন করেন। চুক্তিটি ইতিহাসে মারাঠা-মুঘল সংঘাতের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

কোন্ধানা কেল্লা বা সিংগাড় দুর্গ মহারাষ্ট্রের ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধুমাত্র একটি দুর্গ নয়, বরং এটি মারাঠা বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার প্রতীক।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

কোণার্ক সূর্য মন্দির: এক ঐতিহাসিক বিস্ময়

ভূমিকা: ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শন হলো ওডিশার কোণার্ক সূর্য মন্দির। এই মন্দিরটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!