Breaking News

অন্তিম যাত্রার ‘হোটেল’ এখানে মৃত্যুপথযাত্রী অতিথিরা আসেন মোক্ষ লাভের আশায়

পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়– একটা দশ বাই দশের ঘর। ক্ষীণ বাল্বের আলো জ্বলছে। পাশের একটা ঘর থেকে ভেসে আসছে গীতা পাঠের সুর। নাম সংকীর্তণ চলছে। খাটের মধ্যে শুয়ে রয়েছেন এক মুমুর্ষ রোগী। খাটে শুয়ে থাকা সেই ব্যক্তি জানেন, তিনি তাড়াতাড়ি মারা যাবেন, কিন্তু ঠিক কখন মারা যাবেন তিনি জানেন না। তাঁর পাশে বসে থাকা আত্মীয়, হয়তো পুত্র বা নাতি বসে রয়েছেন। তিনিও জানেন তাঁর সঙ্গে থাকা মানুষ ইহলোক ত্যাগ করবেন, সেই অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছেন।  তাঁরা প্রত্যেকেই জেনে বুঝে এসেছেন অন্তিমযাত্রার পান্থশালায়।

তাঁদের প্রত্যেকেরই আশা, এই মৃত্যু আর পাঁচটা মৃত্যুর থেকে অনেক বেশি মহার্ঘ্য। এই মৃত্যু মানে সম্পূর্ণ মোক্ষ প্রাপ্তী। কারও মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে ১৪ দিনে, কারওবা একদিনেই।  এতোক্ষণ যে বাড়িটার কথা বললাম তার নাম কাশীলাভ মুক্তিভবন। এখানে ধনী থেকে দরিদ্র প্রত্যেকেই আসেন মৃত্যুর অন্তিমযাত্রার শেষ পান্থশালায় কয়েকটি দিন কাটাতে।

বারাণসী। আলোর শহর, পুরাণগাথার শহর, মোক্ষের শহর, হাজারো কাহিনির শহর। প্রায় তিন হাজার বছরের ভারতের প্রচীন নগরীর বিখ্যাত অলিতে গলিতে রয়েছে, হাজারো ইতিহাস, কিংবদন্তী ও কাহিনি। আজকের কাহিনি এমন এক ভবনকে ঘিরে যা, মৃত্যুপথযাত্রীদের পান্থশালা। দেশের বিভিন্ন কোনা থেকে মানুষ আসেন এখানে। এই ভবনে থেকেই তাঁরা অন্তিমলোকে পাড়ি দিতে চান।

প্রচীন কাল থেকেই হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস, কাশীতে মৃত্যু ও অন্ত্যোষ্টি হলে মোক্ষ প্রাপ্তী হয়। পুনর্জন্ম, রোগ, জ্বালা, যন্ত্রণা, ব্যাধি, গণ্ডগোল, লোভ, লালসা হিংসা, দ্বেষ সব কিছু থেকেই মুক্তি মেলে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বহু মানুষ উপলব্ধী করেন এই ভূলোকে জন্ম নিয়ে তারা কী নিয়েছেন, আর কতটা দিয়েছেন।  একটা অংশ যখন মৃত্যুর মতো চরম সত্যকে জেনেও লোভ, লালসা, হিংসার জাল বুনে চলেছেন পরম্পরা ধরে।  কিন্তু সবকিছু জেনে বুঝে যাঁরা আসেন এই ভবনে! মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে, তাঁরা কী উপলব্ধী করেন?

পেজ ফলো করতে ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রায় ৪৭ বছর ধরে এই ভবনের ম্যানেজারের দায়িত্ব সামলেছেন ভৈরবনাথ শুক্লা। তিনি চোখের সামনে দেখেছেন প্রায় ১২ হাজার মৃত্যু। এই ভবনে, বারাণসীর মুক্তিভবনে। তিনি জানিয়েছেন, দেশের ভিন্ন কোনা থেকে মুক্তিভবনে বহু মানুষ এসেছেন, তাঁর আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে। তাঁরা জেনেই এসেছেন, এই ভবন অন্তিমপান্থশালা। মোক্ষগৃহ, জীবন থেকে নিস্তার পাওয়ার শেষ আবাস। বহু মুমুর্ষরোগী, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা মারা গিয়েছেন এই আবাসেই। আবার অনেকের মৃত্যু হয়নি, ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।  হয়তো কাশীতে তাঁদের মৃত্যু স্বীকার করেনি ঈশ্বর!

ভৈরবনাথ শুক্লার বলেন, এই ভবন এক দর্শন পরিবর্তনের আবাস। প্রায় ১২ হাজার মৃত্যুকে দেখেছি। বহু পরিবারকে দেখেছি এখানে রাত কাটাতে। প্রত্যেক পরিবারের নানা কাহানি, আর সব কাহানির মধ্যেই জড়িয়ে একে অপরের সুতো। হয়তো চরিত্র আলাদা, কিন্তু কাহানির রং কোথাও না কোথাও এক।

দীর্ঘ ৪৭ বছরে এই ভবনে হাজারেরও বেশি মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখার পর, অনেক কিছু শিক্ষা পেয়েছি, তার মধ্যে অন্যতম, জীবনে যে দ্বন্দ্ব তোমার জন্য তৈরি হয়েছে, তা এই জীবন থাকতেই মিটিয়ে ফেলো।  কারণ তুমি সৌভাগ্যবান মানব জন্ম পেয়েছে। তুমি সৌভাগ্যবান এখনও জীবীত আছো, কিন্তু তুমি জানো না, কতক্ষণ জীবীত থাকবে।  তাই জীবনে যতগুলি দ্বন্দ্ব, সংকট তোমার জন্য তৈরি হয়েছে, অন্যজন পীড়িত হয়েছে, তা বড় কথা নয়, কিন্তু সেগুলিকে দ্রুত সমাধা করতে তুমি কতটা পদক্ষেপ নিচ্ছ, সেটাই জীবনের সবচেয়ে জরুরি কর্ম।

১৯০৮ সালে বাড়িটি তৈরি করেন হরিরাম গোয়েঙ্কা। ১৯৫০ সালে বাড়িটি কিনে নেন জয়দয়াল ডালমিয়া। তৈরি করা হয় ডালমিয়া ট্রাস্ট। এই ভবনের কাজকর্ম পরিচালনা করে এই ট্রাস্ট।  মোট ১০টি ঘর রয়েছে। আবাসিকদের এখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় ১৪ দিন। ভবনে আসার পর কোনও আবাসিকের মৃত্যু না হলে, তাকে ঘর ছাড়তে হয়।  আবাসিকদের কাছে কোনওরকম টাকা পয়সা নেওয়া হয় না, শুধুমাত্র ইলেকট্রিক চার্জ নেওয়া হয়।  ভবনে নিজেরা রান্না করে খাওয়া দাওয়া করতে চাইলে, বাসনপত্রও দেওয়া হয় আবাসনের তরফে।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

কাশ্মীরের এই পাঁচটি জায়গা একদম অফবিট, এবারে সফরের তালিকায় অবশ্যই রাখুন

স্বাতী চ্যাটার্জি- ভূস্বর্গ কাশ্মীর, মুঘল সম্রাট এই উপত্যকা দেখার পর বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!