অর্বিট ডেস্ক– অতি সম্প্রতি একটি ছবি রিলিজ হয়েছে জয় ভীম নামে। আর এই ছবিকে ঘিরেই তুলকালাম বিতর্কের জন্ম নিয়েছে। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন দক্ষিণের জনপ্রিয় অভিনেতা সূর্য।
ছবিটির মূল বিতর্ক হল, কাহানি সত্য ঘটনা অবলম্বনে হলেও, কিছু তথ্য ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বিকৃত করা হয়েছে। গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, সমাজের নীচু শ্রেণির মানুষের লড়াই ও অধিকার নিয়ে।
ঘটনাটি হল, ১৯৯৩ সালে এক ইরুলা উপজাতির রাজাকান্নু নামে এক ব্যক্তি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ কাস্টডিতে অকথ্য অত্যচার করা হয়। তারপর তার আর কোনও খোঁজ মেলে না। সেই উত্তর খুঁজতে রাজাকান্নুর গর্ভবতী স্ত্রী সেঙ্গেনির লড়াই শুরু হয়। তাঁর পাশে দাঁড়ান আইনজীবী চন্দ্রু।
আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাটি ভারতের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীন ভারতেও এমন ভুরি ভুরি ঘটনার উদাহরণ মেলে। কিন্তু এই ছবি বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ কারণ, যে আইনি লড়াইয়ের জন্য ছবিটি তৈরি করা, সেই একই অপরাধে দুষ্ট। সেগুলি একে একে পোস্টমর্টাম করা যাক।
১। ছবিটিতে এক নিরপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়, অকথ্য পুলিশ কাস্টডিতে অত্যাচার করা হয়। পরে তাকে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাত যে দোষ করেনি, তাঁর নামে দোষ চাপানোর বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে ছবি। মূল ঘটনায় যে অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকরা ছিলেন অন্য। কিন্তু ছবিতে দেখানো হয়েছে, অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার ভন্নিয়ার সম্প্রদায়ের। অর্থাত। এখানে ছবিতে সেই ব্রহ্মণ্যবাদকে অত্যন্ত সচতুর ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
২। ছবির নামও অত্যন্ত সুকৌশলে রাখা হয়েছে ‘জয় ভীম’। তার বিশেষ কারণ হল, এটি ভারতে জয় ভীম নামক যে আন্ডার কারেন্ট মুভমেন্ট চলছে তার প্রমোট করা। ছবিটি ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, এটি একটি অপরাধের ঘটনা, যা এখনও ঘটে চলেছে বাস্তবে। কিন্তু ছবির মাধ্যমে সরাসরি আঘাত করা হয়েছে ব্রহ্মণ্যবাদকে। আসল ঘটনায় অপরাধীর নাম বদল করে, হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদকে দেখানো হয়েছে।
৩। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, অন্য সম্প্রদায়ের অফিসারের বদলে ব্রাহ্মণ্যবাদ দেখালে কী ক্ষতি হয়েছে? ক্ষতি আছে, তার উত্তর রয়েছে ইতিহাসে। আসুন দেখা যাক ইতিহাস ঘেঁটে।
ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর, নিজেদের কব্জা জমাতে থাকে। ভারতসহ এশিয়া মহাদেশে যেখানে উপনিবেশ হয়েছে, সেখানে তারা নীচু শ্রেণির জনজাতিদের ধর্মান্তকরণ করিয়েছে। এ ইতিহাস অজানা নয়। কিন্তু একটা শ্রেণির জনজাতি ধর্মান্তকরণে রাজি হয়নি। বরং তাদের জল জঙ্গল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারই নজির সিধু, কানহুর চুয়াড় বিদ্রোহ।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর, ব্রিটিশরা ১৮৭১ সালে একটি কালা আইন আনে। নাম ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট। এই আইন মতে, আইনে তালিকাভুক্ত উপজাতিদের ঘরে কোনও শিশু জন্ম নিলেও সে ওই কালা আইনের আওতায় পড়বে। এলাকায় চুরি, ছিন্তাই, খুন হলে নানা ফৌজদারি অপরাধ হলে, সবার আগে তাদেরই গ্রেফতার করা হত।
ভারতের ধাপে ধাপে এই আইন লাগু করা হয়, বোম্বে প্রোসিডেন্সি, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা প্রেসিডেন্সিতে। ধাপে ধাপে মোট ২৩৭টি উপজাতিকে এই আইনের আওতায় আনা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, ডঃ ভীমরাও আম্বেদর ভারতের ব্রহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই শুরু করেছেন। দলিতদের লড়াইয়ের জন্য ময়দান কাঁপাচ্ছেন।
১৯২৭ সালে ২৫ ডিসেম্বর সাড়ম্বরে পালন করলেন মনুস্মৃতি দহন। তাঁর মূল লড়াইয়ের টার্গেট হল ব্রাহ্মণ্যবাদের শোষণ। তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ২৩৭টি অপরাধপ্রবণ উপজাতির জন্য লড়াই করেছিলেন? না, তাঁর লেখা বা সারা জীবনের কর্মকাণ্ডে এই কালা আইনের বিরোধিতা কোনও দিন করতে দেখে যায় নি।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, দেশের প্রথম আইনমন্ত্রী হলেন ভীমরাও আম্বেদকর। ব্রিটিশদের অবদান ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট নিয়ে কোনও জোর লড়াই করার রেকর্ড রয়েছে গান্ধী, নেহেরু, আম্বেদকরের? না সরকারি কোনও রেকর্ড নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বহাল তবিয়তে রয়ে গেল ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট।
পরে রাষ্ট্রপুঞ্জের আপত্তিতে আইনের শুধু জামা বদল করা হয়। ১৯৫২ সালে নাম হয় হ্যাবিচ্যুয়াল অফেন্ডারস অ্যাক্ট। তারপর এই কালা আইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই চালান মহাশ্বেতা দেবী। বেশ কয়েক দশক বাদে, ধীরে এই আইনের কালা ব্যবহার বন্ধ হয়। এখানে তাহলে প্রশ্ন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে তপশীলী জাতি উপজাতিদের নামে সংরক্ষণ করেছিলেন আম্বেদর, সেই সুযোগ সুবিধা এতোদিন কারা পেয়ে এসেছেন?
বর্তমানে এই কালা আইনের কথা পুরো চেপে রেখে, নীচু জাতিদের মধ্যে অত্যন্ত সুচতুর ভাবে ঢোকানো হচ্ছে সেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিষ। তার বর্তমান উদাহরণ জয় ভীম ছবি। তলায় তলায় একটি আম্বেদকরের সেই পুরনো দাবি সেপারেট ইলেক্টরেটসের ফাউন্ডেশনকে জোরালো করা হচ্ছে।
সেপারেট ইলেক্টরেট কি? যে অঞ্চলে নীচু জাতি ও ধর্মীয় সংখ্যাগুরু যারা থাকবেন, সেখানে উঁচুজাতির কেউ ভোটাধিকারই প্রয়োগ করতে পারবেন না। ধরা যাক একটি পঞ্চায়েত এলাকায় ৫৫ শতাংশ মুসিম সম্প্রদায় থাকলে, সেই আসন মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ থাকবে, কিন্তু অন্য ধর্মের উঁচু জাতির লোকেরা ভোটাধিকার পাবেন না।
OUR FACEBOOK PAGE CLICK HERE
এই সেপারেট ইলেক্টরেটসের দাবি, তুলতে শুরু করেছেন, উত্তরপ্রদেশের মায়াবতীর পার্টি বহুজন সমাজ পার্টির শাখা সংগঠন। তাঁদের দাবি, জনপ্রতিনিধি থেকে আমলা, বিচারব্যবস্থা, সরকারি চাকরি, শিক্ষা ব্যবস্থা সবক্ষেত্রে সংরক্ষণ থাকলেও, তা আদপে ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতেই রয়েছে। তাই সংরক্ষণের পাশাপাশি সেপারেট ইলেক্টরেট প্রয়োজন।
‘জয় ভীম’ ছবিতে খ্রিস্টান অফিসারের বদলে ভন্নিয়ার সম্প্রদায়কে দেখানো মানে সেই ব্রহ্মণ্যবাদকেই শিখন্ডি খাড়া করে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এখান এখানে প্রশ্ন, দেশের মধ্যে এই বিভাজন নীতি আমদানির পিছনে কি কোনও আন্তর্জাতিক চক্র রয়েছে? তা জবাব দেবে সময়ই।