পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- প্রাচীন গ্রিক মহাকাব্যের মধ্যে অন্যতম অ্যার্গোনটিকা। ভারতের বৈদিক শাস্ত্র যেমন ছিল শ্রুতি কেন্দ্রীক। তেমনই গ্রিকদের বহু মহাকাব্যই ছিল শ্রুতি নির্ভর। প্রচীনকালে মিশরের সঙ্গে গ্রিসের কূটনৈতিক সম্পর্কে যেমন ছিল চাপান উতোর, তেমনই বাণিজ্য সম্পর্কে কোনও খামতি ছিল না। এথেন্স থেকে বণিকরা জাহাজ ছাড়লে, অ্যগেনিয়ান সাগর পার করতে হত। আসতে হত ইজিপ্টের থোনিস বন্দরে। এর মাঝে অবশ্য অ্যগেনিয়ান সাগরের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু দ্বীপকে অতিক্রান্ত হতে হত গ্রিক বণিকদের।
গ্রিসের প্রচীন বণিকরা মনে করত, অ্যগেনিয়ান সাগরের বুকে বহু দ্বীপেই রয়েছে, শয়তানি শক্তির গড়। দ্বীপগুলির পাশ দিয়ে যেতে গেলেই রাতের অন্ধকারে মায়াবী নারীদের সঙ্গীত ভেসে আসতে। নাবিকরা সেই মধুর সঙ্গীতে আচ্ছন্ন হয়ে দ্বীপের মধ্যে ভিড়িয়ে দিত জাহাজ। ঠিক এমনি ভাবেই শত শত নাবিক, বণিকসহ জাহাজ উধাও হয়ে যেত অ্যগেনিয়ান সাগরের বুকে। প্রায় ৫০ বছর ধরে চলেছিল এমন দুর্ঘটনা।
অগত্যা, রাজার নির্দেশে এক তান্ত্রিক বণিক ও নাবিকদের জন্য ফর্মান জারি করলেন। দূর থেকে এমন মায়াবী সঙ্গীতের সামান্য শব্দ পেলেই, প্রত্যেকটি জাহাজের সমস্ত জাহাজের নাবিক, বণিক, যাত্রীদের কানে, পাতা ও কাপড়ের আস্তরণ দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তারপর সেখানে মোম গলিয়ে ঢেলে দিতে হবে। আমরা আধুনিক সময়ে ঠিক যেভাবে শীতকালে মাফলার জড়াই, ঠিক তেমন ভাবেই কাপড়, তুলো, পাতা দিয়ে ঢেকে মোমের আস্তরণ চাপিয়ে দেওয়া হত। দাওয়াই কাজে এলো। এক ধাক্কায় জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকটাই কমে গেল।
ঠিক তেমনই প্রকৃতির মধ্যেই এমন অসংখ্যা শব্দ, ধ্বনি রয়েছে, যা সঙ্গীতই বটে। যা আপনাকে মায়াময় করে মোহিত করে দিতে পারে। আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে বহুকাল। ভারতে বাণিজ্য করতে এসে হয়তো এমনই রত্নাকরের সঙ্গীতে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, ডেনমার্কের এক রাজা চতুর্থ ক্রিস্টিয়ান।
পুদুচেরি থেকে করমণ্ডলের উপকূল ধরে প্রায় ১২০ কিলোমিটার গেলেই পড়বে সাগরতীরে গজিয়ে ওঠা এক গঞ্জ। একটা সময় এখানে স্থানীয় জেলেদের বাস ছিল। সপ্তদশ শতকে এই জায়গাটিরই প্রেমে পড়ে যান ডেনমার্কের রাজা। জায়গাটির স্থানীয় নাম, তরঙ্গমবাড়ি। ড্যানিসদের দেওয়া নাম ট্র্যঙ্ক্যুইবার। এখানে শীত তেমন ভাবে পড়ে না, আকাশে ছটায় গোধুলিও সেভাবে আসে না। পর্যটকের ভিড়ও তেমন নেই।
প্রায় চারশো বছর আগে ভারতে ব্যবসা করতে এসে পর্তুগিজ ও ব্রিটিশরা ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে। সেই দেখে আসতে শুরু করে ডেনমার্কের বণিকরা। ১৬১৬ সালে ডেনমার্কে গঠন হয় ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। রাজার কূটনৈতিক দূত, নৌবাহিনীর সেনাপতি ওভে গেদে বাণিজ্য তরী নিয়ে পাড়ি দেন ভারতে। নামলেন করমণ্ডল উপকূলে। গড়ে উঠল ইন্দো-ডেনমার্ক বাণিজ্যকেন্দ্র।
১৬২০ সালে ডেনমার্কের রাজার সঙ্গে তাঞ্জাভুরের রাজা রঘুনাথ নায়েকের চুক্তি হল। বছরে ৩১১১ টাকা ভাড়ায় ওভে গেদের হাতে তুলে দেওয়া হল জেলেদের গ্রাম। তারপরেই এখানে গজিয়ে উঠল প্রথম ড্যানিশ কলোনি। তৈরি হল, দুর্গ, বন্দর, মহল, অট্টালিকা এবং চার্চ। সাধারণত মশলা, সুতির বস্ত্র, সোনা রুপো ইত্যাদি রফতানি করা হত এখান থেকেই। ১৮৪৫ সালে ট্র্যঙ্কুইবার ইংরেজদের দখলে যায়। ড্যানিশদের কাছ থেকে তারা কিনে নেয়, কেল্লাসহ পুরো জনপদ। ডেনমার্কের গভর্নর ও বণিকরা ফিরে যান দেশে।
২০০৪ সালে ট্র্যাঙ্কুইবার সুনামি আছড়ে পড়ে। তছনছ, লণ্ডভণ্ড করে দেয় প্রকৃতি। ব্যাপক ক্ষতির মুখ দেখে তরঙ্গমবাড়ি। মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৮০০ মানুষ। এখনও অবশ্য অনেক কিছুই অবশিষ্ট রয়েছে এখানে। ১৯৭৯ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ চালু করে একটি সংগ্রাহশালা। সেখানে রাখা আছে, ইন্দো ডেনমার্ক বাণিজ্যের নানা নিদর্শন. ছবি, জাহাজের নানা অংশ। জেনমার্কের রাজ পরিবার, নায়েক রাজবংশ এবং বিজয়নগরের রাজাদের ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিসপত্র।
দেশের স্বাধীনতার পর, এখানকার কেল্লাকে সরকারি বাংলো হিসেবে কিছুকাল ব্যবহার করা হয়। অনেকে দাবি করেন, ডেনমার্কে ক্রোনবর্গ দুর্গের পরেই ড্যানিশদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুর্গ এটি।
এখানে থাকার ব্যবস্থা অত্যন্ত কম। তবে চাইলে একটা দুটো রাত কাটাতেই পারেন এখানে। থাকার জন্য রয়েছে হেরিটেজ হোটেল বাংলো অন দ্যা বিচ, রয়্যাল পার্ক গেস্টহাউশ এবং নিপ্পন প্যালেস গেস্ট হাউস।