পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– অখণ্ড রামায়ণ পড়েছেন হয়তো অনেক কম লোক, কিন্তু এই মহাকাব্যের নাম শোনেননি এমন মানুষ ভূ ভারতে মেলা দুষ্কর। আর রামায়ণ মানেই, বিখ্যাত কয়েকটি চরিত্রকে ভোলার নয়, তার মধ্যে অন্যতম হনুমান।
শ্রীরামভক্ত হনুমান। ভারতের যতগুলি ধারার রামায়ণ রয়েছে প্রত্যেকটিতে হনুমানকে ব্রহ্মচারী দেখানো হয়েছে। অর্থাত্ হনুমান কোনওদিন বিবাহই করেননি। তাহলে! হনুমানের স্ত্রী এলো কোথা থেকে? আর রামসেতুর সঙ্গে হনুমানের বিবার পর্ব জুড়ে গেল কীভাবে! আর ধনুষকোটি নামকরণ কীভাবে হয়ে উঠল? এর পিছনে রহস্য আর পৌরাণিক যুক্তিই বা কী!
সবার আগে আসা যাক, ধনুষকোটি বা ধনুষকোডির ইতিহাসে, তারপর যাবো পৌরাণিক কাহিনিতে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তামিলনাড়ুর পূর্বে বঙ্গপোসাগর ও আরবসাগরের বুক চিরে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত একটি দ্রুত পৌঁছনোর রাস্তা খুঁজে পায় ব্রিটিশরা।
একটি দ্বীপের মতো অংশ। তামিলনাড়ুর থেকে সেই দ্বীপ পর্যন্ত তারা দুটি রাস্তা বানিয়েছিল। ছিল রেল ও সড়কপথ। একটি ছোটখাটো শহরও ছিল, ছিল স্কুল, ডাকঘর, চার্চ আবাসন। ১৯৬৪ সালের এক বিধ্বংসী সামুদ্রিক ঝড়ে সেটি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলস্তর বাড়ে, তলায় চলে যায় ধনুষকোডি। অথচ ইংরেজ শাসনকালে, এই ধনুষকোডি থেকে ফেরিতে শ্রীলঙ্কায় যাতায়াত করা হত।
সাইক্লোনের দুদিন পর উদ্ধারকর্মীরা ধনুষকোটিতে পৌঁছনোর চেষ্টা করে। কিন্তু খালি হাতে ফিরে আসে। সেখানে কোনও দ্বীপ ছিল না। পুরো জলের তলায়। ধনুষকোডিতে সেই সময় বাস করতো প্রায় ২ হাজার মানুষ। কারও কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
এবার আসা যাক পৌরাণিক কাহিনিতে, রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার সময়ই লঙ্কায় পৌঁছনোর আগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এই জলপথ। শুরু হয় বানরসেনার অসম লড়াই। নির্মাণ করা হয়, রামসেতু। আর এখানেই আসে এক কাহিনি। রামসেতু নির্মাণের সময়ই বারবার সেতু নির্মাণে সমস্যা দাঁড়াচ্ছিল, কেউ যেন এসে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে হনুমান।
একদিন, সেতু নির্মাণের পর, ক্লান্ত বানরসেনা যখন রাতে বিশ্রাম নিচ্ছে, সেই সময় পুরো সেতু পাহারায় থাকলেন হনুমান। জলের শব্দতরঙ্গে বুঝতে পারলেন বিপদ আসছে, সোজা জলের তলায় ডুব দিয়ে পাকড়াও করলেন এক মত্স্যকন্যাকে।
অপরূপ সুন্দরী, তেমন ক্ষিপ্র, হনুমানকে দেখে বিদ্যুতের বেগে পালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু হনুমানের ঝড়ের গতির কাছে হার মানতে হল তাঁকে। হনুমান তাঁকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করলেন, হে জলদেবী, ভগবান শ্রীরামের নামে সেতু তৈরি হচ্ছে মাতা সীতাকে উদ্ধারের জন্য। কে বাধা দিচ্ছেন বারবার!
মত্স্যকন্যা তাঁকে বললেন, আমি ভেঙে দিচ্ছিল্লাম, আমার নাম সুবর্ণামত্স্য। আগে আমার কাছে হার স্বীকার করো নয়, এই সেতু আবার ভেঙে দেবো, আপনারা যেতে পারবেন না।
হনুমান উত্তর দেয়, আমি ভগবান শ্রীরাম ছাড়া কারও কাছে হার স্বীকার করি না। এ ছাড়া আর কী চান আমার কাছে বলুন, আমি মহিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিনা।
সুবর্ণমত্স্য বললেন, একমাত্র উপায় তুমি আমাকে বিবাহ করো। আমি তোমার প্রেমপ্রার্থী। হনুমান প্রতিশ্রুতি মতো তাঁকে বিবাহ করে বললেন, এই সেতু নির্মাণে কোনও শত্রু শক্তি যেন আসতে না পারে, সে ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।
সুবর্ণমত্স্য কথা দিলেন, এ আমার এলাকা, তোমরা নির্ভয়ে সেতু নির্মাণ করো। তবে সেতুর কাঠামো তোমার ভগবানের ধনুকের মতো যেন হয়। এর পরেই, হনুমানের নির্দেশে রামের ধনুকের মতো সেতু নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে রামসেতুর জায়গার নাম হয় ধনুষ কোটি অনেকে ধনুষকোডিও বলে থাকেন। অর্থাত ধনুকের শেষ অংশ।
উল্লেখ্য, হনুমান ও মত্স্যকন্যার বিবাহ পর্ব কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের রামায়ণে দেখা যায়।