Breaking News

সিকিম কোন কৌশলে ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল

অর্বিট ডেস্ক-অনেকেই সিকিম বেড়াতে যান। কিন্তু আমরা কতজনইবা জানি সিকিমের আসল ইতিহাস। আসুন এবারের পর্বে দেখা যাক সিকিমের এক ধুলো চাপা পড়া ইতিহাস। কী ভাবে সিকিম হয়ে উঠল ভারতের অন্যতম অঙ্গরাজ্য।সিকিম কয়েকশ বছর ধরে এক প্রাচীন সাম্রাজ্য ছিল। সময়ের সঙ্গে জল গড়িয়েছে, রাজনৈতিক চাপান উতোর, পট পরিবর্তন হয়েছে সিকিমে।

সবার আগে দেখে নেওয়া যাক সিকিমের ভৌগলিক অবস্থান। উত্তরে তিব্বত, পূর্বে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল এবং দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে সিকিমের অবস্থান অনেক টাই স্পষ্ট করা যায় যে, চারপাশেই ছিল ভিন্ন সাম্রাজ্য।সিকিমের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে মূলত তিব্বত এবং নেপালি সংস্কৃতি ধরা পড়ে। কারণ সিকিমের সর্বপ্রথম যে রাজা এসেছিল,তা তিব্বত থেকেই। পরে সিকিমে একটা বড় অংশ আসে নেপাল থেকে। বর্তমানে জনসংখ্যার বিচার করলে সংখ্যাগুরু নেপালি।সিকিমের প্রথম দিকে সাম্রাজ্য ছিল একনায়কতন্ত্রের। একজন রাজা থাকতো, যাকে বলা হত চোগিয়াল। এবং সাম্রাজ্যের নাম নামগিয়াল। জম্মু ও কাশ্মীরের লেতে যে নামগিয়াল সাম্রাজ্য রয়েছে, এটি তার থেকে ভিন্ন শাখা।

সপ্তদশ শতকে সিকিমে এক চোগিয়াল নিজের রাজ্য তৈরি করে, যদিও তাদের সম্পর্ক তিব্বতের সঙ্গে অনেক ভালো ছিল। মনে করা হয়, সেই রাজা তিব্বত থেকেই এসেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে সিকিমের একটা পট পরিবর্তন হয়। সেটি হল নেপালের আক্রমণ। নেপালের গোর্খা সাম্রাজ্য হামলা চালায় এবং প্রায় ৪০ বছর সিকিম নেপালের দখলে থাকে। এই সময়ই বহু নেপালি সিকিমে বসবাস শুরু করে।এখানে বলে রাখি, সিকিমে আগে যাঁরা বাসিন্দা ছিলেন, তাঁরা মূলত লেপচা বা ভুটিয়া। তাঁর লৌকিক ধর্ম ছিল পরে বৌদ্ধ ধর্মে প্রবর্তিত হয়। এই সময় আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের সঙ্গে শত্রুতা ছিল নেপালের। আর এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিকিমের সঙ্গে সু সম্পর্ক তৈরি করে। সময়টা ১৮১০।

১৮১৪-১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালে যুদ্ধহয়, সেখানে নেপাল হেরে যায়, এবং একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার নাম ট্রিটি অফ সুগলি। এই সময় সিকিমের সঙ্গেও একটি চুক্তি করে ব্রিটিশরা। নাম ট্রিটি এফ তিতালিয়া। চুক্তি অনুসারে সিকিমের যে সীমানা ছিল তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় নেপাল। অন্যদিকে সিকিমের কাছে দার্জিলিং নেওয়ার চুক্তি করে ব্রিটিশরা। ইংরেজেদের চাহিদা মতো, বছরে ৬ হাজার টাকার নজরানায় ব্রিটিশদের হাতে দার্জিলিং তুলে দেওয়া হয়, কারণ সেখানে চা শিল্পের জমি ও হিল স্টেশন প্রয়োজন ছিল।হয়তো ভাবছেন, ব্রিটিশের সঙ্গে সিকিমের সম্পর্ক হয়তো ভালো ছিল, কিন্তু না, সেটা বেশিদিন চলেনি।

কারণ ইংরেজরা বাৎসরিক যে ৬ হাজার টাকা তা দেওয়া বন্ধ করে। এর পরেই সিকিমের রাজা দার্জিলিঙে অস্থিরতা তৈরি করে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এতোটাই বোগতিক হয় যে, ১৮৫০ সালে এবং ১৮৬২ সালে দুবার সেনা পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। যদিও ব্রিটিশরা বাৎসরিক টাকা দিতে থাকে এবং ১২ হাজার করে দেয়।কিছু সময় পরে ইংরেজরা দাবি করে, সিকিমকে তারা রক্ষা করছে, এটি ব্রিটিশদের প্রোটেক্টরেট এরিয়া। ১৮৯০ সালে এই স্টেটাস আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশও করে ইংরেজরা। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ এবং চিনের মধ্যে এক সন্ধি হয়, সেই চুক্তিতে বলা হয়, সিকিমের মধ্যে চিন ঢুকতে পারবে না এবং তিব্বতে ব্রিটিশরাও নাক গলাবে না।এর ফলেই সিকিমের রাজা স্বাধীন হলেও, ব্রিটিশদের দ্বারা প্রোটেক্টরেট ছিল তারা।

আরও পড়ুন-চলুন বেড়িয়ে আসি সিকিম, অপরূপা প্রকৃতির খোঁজে

সিকিমের রাজা বিদেশ নীতিতে স্বাধীন ছিল না, এবং নিজস্ব সেনা মোতায়েনের ক্ষমতাও ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও, ১৯৫০ পর্যন্ত এই আইন বলবৎ ছিল।এখানে বলে রাখি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, জম্মু ও কাশ্মীর, জুনাগড়, হায়দরাবাদ এবং সিকিম ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরে সংযুক্ত হয়েছে, তবে সিকিমের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এবং সরকারি নীতিটা একটু ভিন্ন ছিল, সেটাই তুলে ধরছি। কারণ স্বাধীনতার পরেও আরও কোনও রাজ্য প্রোটেক্টরেট মর্যাদা পায়নি বা দেওয়া হয়নি। ১৯৫০ সালে সিকিমের সঙ্গে ভারতের একটি নতুন চুক্তি হয়, সেখানেও তাদের প্রোটেক্টরেট মর্যাদায় রাখা হয়, বলা হয়, সিকিমের ভারত সরকার কোনও প্রশাসনিক কাজ কর্ম প্রত্যক্ষভাবে করবে না।

এখানে একটা অংশ বলে রাখি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সিকিমে সংখ্যাগুরু নেপালি এবং শাসন চলতো লেপচাগোষ্ঠীর রাজাদের জনসংখ্যা হারে এবং বৌদ্ধিক ধর্মালম্বী মতে দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে খ্রিস্টান, চতুর্থ স্থানে ইসলাম এবং পঞ্চম স্থানে অন্যান্য।এখানে বোঝাই যাচ্ছে, সংখ্যা গুরু যারা তারা প্রজার ভূমিকায় আর সংখ্যালঘু আদি জনগোষ্ঠী শাসন করছে, সেখানেতো সমস্যা হওয়ারই কথা। আর সেটা শুরু হয়েছি ১৯৪০ এর সময় থেকেই যখন ভারতে ইংরেজ তাড়াও আন্দোলন চরমে, সেই সময় সিকিমেও তার প্রভাব পড়ে। সেখানেও তৈরি হয় সিকিম কংগ্রেস। এবং সেই দলে প্রধানত ছিল নেপালিরাই। তাদেরও দাবি ছিল, সিকিমে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রণয়ন করা। রাজা থাকুন কিন্তু তার সঙ্গে সাংবিধানিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও হোক।১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, সেই সময় সিকিমের রাজা ছিলেন তাশি নামগিয়াল। তাঁর সঙ্গে ১৯৫০ সালে ইন্দো সিকিম ট্রিটি স্বাক্ষর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। সেই সময় স্বাধীন ভারতের সেই প্রোটেক্টরেট তকমা জারি রাখা হয়।

এই সময় রাজাও ঠিক করে, যে সিকিমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে, সিকিম কংগ্রেসের দাবি মানা হয়। এই সময়ই সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন কাজি লেনডুপ দোরজি। এখানে রাজাও ছিল এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও চালু হল। যদিও ক্ষমতার দিক থেকে রাজাই প্রধান। যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতিতে অবশ্য ভারত সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল।সিকিমের রাজা তাশি নামগিয়াল বিদেশ সফরে গেলেই, সিকিমকে আলাদা স্বাধীন রাজ্য বলে তুলে ধরতো । এমনকী ভারতের পতাকাও ব্যবহার করতো না। বিদেশে সবসময়ই প্রচার করতো সিকিম সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাষ্ট্র, যেন ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতো। আর এই বিষয়টিই ভালো লাগেনি ভারত সরকারের। ১৯৬৩ সালে তাশি নামগিয়ালের মৃত্যু হয়, ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যু হয়। এই সময় সিকিমে ক্ষমতায় বসে তাশির ছেলে পালডেন থনডুপ নামগিয়াল।

পালডেন ক্ষমতায় বসার পরেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তাঁর এক তিব্বতী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, আর এক মার্কিনিকে বিয়ে করেন। নাম হোপ কুক। এই হোপ কুকের উপর অভিযোগ ওঠে, তিনি আসলে সি আই এ এজেন্ট। এবং জেনে বুঝেই সিকিমের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা এবং রাজাকে হাতের মুঠোয় করে নিজের ক্ষমতা পরিচালনা করেন। যদিও ১৯৭৩ সালে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এবং আমেরিকা ফিরে যায় হোপ কুক। এই হোপ কুক, বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় লেখেন, সিকিম আলাদা একটি রাজ্য, ভারত সরকারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। এবং লেখার মধ্যে ভারত বিরোধী কথাও ছিল। এখানে বলা ভালো, সিকিমে সাংবিধানিক ক্ষমতায়ণ হওয়ার পরেই ভারতের তরফে একজন প্রশাসনিক প্রতিনিধি রাখা হত। এবং তা প্রবীণ আই সি এস (বর্তমানে আই এ এস) চিফ সেক্রেটারি পদমর্যাদার।

১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে উত্তাল হয়ে ওঠে। চিব্বতে চিনের আগ্রাসন, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিজিমের রক্তক্ষয়ী উত্থান, নেপালেও কমিউনিজিমের প্রভাব। অন্যদিকে ১৯৬৭ সালে চিন, সিকিমকে প্রায় দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রায় ১০ দিন লড়াই চালিয়ে ভারতীয় সেনা চিনা ফৌজকে পিছু হটাতে বাধ্য করে।১৯৭৩ সালে সিকিমে বিক্ষোভ বেশ জমাট বাঁধে। প্রধান ছিল সিকিম কংগ্রেস। একাংশের মত, সেই সময় রাজা ক্ষমতা খর্ব করে পুরোপুরি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু করতেই এই বিক্ষোভকে ফান্ডিং করতো তৎকালীন ভারত সরকার। এ বিষয়ে ভারত সরকার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে কাজে লাগায়। যেখানে অজিত দোভালের ১৯৬৭ সালের আই পি এস ব্যাচ (তৎকালীন ইন্টেলিজেন্স অফিসার, বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা)এই পরিস্থিতির মধ্যে সিকিমের রাজা ভারতের কাছে সেনা পাঠানোর আর্জি জানায়। এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার অনুরোধ করে।

সেই সময় ১৯৭৩ সালে মে মাসে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়, সিকিমে নির্বাচন হবে একদম ভিন্ন পদ্ধতিতে। ক্ষমতা পুরোপুরি থাকবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপর। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নেবে সরকার।এই চুক্তির পরেই ভারতের তরফে একটি ড্রাফ্ট কন্সিটিটিউশন তৈরি করা হয়। আর এতেই আপত্তি জানায় চোগিয়াল। তার দাবি, নতুন সংবিধান হলেতো রাজা কোনও ক্ষমতাই থাকবে না। এদিকে ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে যে নির্বাচন হয়, তাতে সিকিম কংগ্রেস প্রায় সব আসনেই জিতে যায়। এরা মূলত ভারত সরকারের পক্ষে ছিল। ওরা চাইতো, ভারত সরকার যা ভাবছে সেই ভাবেই চলুক সিকিম।১৯৭৪ সালের শেষের দিকে ভারত সরকার সিকিমকে অঙ্গরাজ্য হিসেবে যুক্ত করার জন্য ৩৬ তম সংবিধান সংশোধনীর কাজ শুরু করে দেয়। এবং হাওয়া ওঠে, সিকিম পুরোপুরি ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে উঠছে।

এই সময় জাতীয় স্তরের যত সংবাদপত্র ছিল, সবাই ভারত সরকারের কড়া সমালোচনা করে। বলা হয়, রাজনৈতিক ভাবে একটি রাজাকে সরানো হচ্ছে এবং প্রায় রাজ্যটি প্রশাসনিক ভাবে দখল করা হচ্ছে।যেখানে কাশ্মীর বা জুনাগড়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি নেওয়া হয়েছে, সেখানে সিকিমের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ কেন? ১৯৭৫ সালে এপ্রিলে অশান্ত হয়ে ওঠে সিকিম। এই সময়ই ভারত সেনা পাঠায় গ্যাংটকে। রাজা ৩০০ সেনা কর্মীকে বন্দি করে নেয় ভারতীয় সেনা। এবং চোগিয়ালকে গৃহবন্দি করা হয়। কিছু দিনের মধ্যে সিকিম বিধানসভায় অধিবেশন ডাকা হয়। সেখানে চোগিয়ালের ক্ষমতা পুরোপুরি অবলুপ্তি করা হয়। যদিও চোগিয়াল বিক্ষোভ দেখাতে থাকে।

এদিকে এই পরিস্থিতিতে ভারতকেও সহিষ্ণুতার প্রমাণ দিতে হবে। তাই ভারত একটি গণভোটের ডাক দেয়, পাঁচ দিনের মধ্যে সিকিমে গণভোট হয়, প্রায় ৬০ হাজার ভোট পড়ে ভারত সরকারের পক্ষে আর দেড় হাজার ভোট যায় চোগিয়ালের পক্ষে।এই গণভোটেও নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। যেখানে সিকিমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছতে দু তিন দিন সময় লাগে সেখানে মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে গণভোট করালো কী ভাবে ? ২২ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে লোকসভায় ৩৬ তম সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করায়, সেখানেই সিকিম পুরোপুরি ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই সময় ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে সিকিম স্বীকৃতি পায়।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

কাশ্মীরের এই পাঁচটি জায়গা একদম অফবিট, এবারে সফরের তালিকায় অবশ্যই রাখুন

স্বাতী চ্যাটার্জি- ভূস্বর্গ কাশ্মীর, মুঘল সম্রাট এই উপত্যকা দেখার পর বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে …

error: Content is protected !!