পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- জীবনে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা হয়তো বিজ্ঞান বা যুক্তিশাস্ত্রের কাছে থাকে না। অথচ সেই সব ঘটনা জীবনে এক একটা অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল, ২০১৪ সালের বাংলাদেশ সফরে গিয়ে। আমরা কয়েকজন বন্ধু অত্যন্ত রোমাঞ্চকর এক সফরে বেরোই, কিন্তু তা যে এতোটা মর্মান্তিক ও ভয়াবহ হবে, তা যাত্রার শুরুতে আন্দাজ করতে পারিনি।
আমরা পাঁচ বন্ধু ঠিক করি, বাংলাদেশের ইতিহাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই দুই মিলেয়ে সফরনামা সাজাবো। কিন্তু তা সাজাতে গিয়েই বেশ কয়েক দফায় আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। অগত্যা ফেসবুকের মাধ্যমেই কয়েকজন বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য নিই। আমাদের প্রত্যাশা শুনে, তারা প্রায় প্রত্যেকেই হাত তোলে, তার অন্যতম কারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। সবার গলাতেই এক সুর, ভাই, এটা ভারত না, আপনি যা চাচ্ছেন, তেমন ট্যুর সমস্যার।
আসলে আমরা চাইছিলাম পুরো সফরটাই করবো, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে, আর বাংলাদেশের বন্ধুদের দাবি, ওখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুব একটা ভালো না। কিন্তু আমরা কম খরচে ট্যুরে যাওয়ার পক্ষে। এর দুটো কারণ, এক পাবলিক কমিউনিকেশন অনেক বেটার হয়, আর জায়গা সম্পর্কে অনেকটা বেশি জানা যায়।
বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা ছিল প্রায় ১৫ দিনের। সেই মতো প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পাণ্ডব, আমি, শঙ্কু, দীপ, রাজেন, অগ্নি। বেরোলাম কিছুটা এলোমেলো পথে। ১ অগাস্ট, শুক্রবার। ২০১৪। শিয়ালদহ থেকে সকালের বনগাঁ লোকাল একদম অন্তিম স্টেশন, সেখান থেকে অটোতে পেট্রাপোল ভারত বাংলাদেশ বর্ডার। পাসপোর্ট ভিসা দেখিয়ে অভিবাসনের কাজকর্ম মিটিয়ে, বাসে চাপলাম। প্রথম গন্তব্য যশোর।
সেদিনই বিকেলে যশোরের একটা হোটেল নিলাম। পরিকল্পনা মাফিক, পরের দিন সকাল সকাল যোশর থেকে বাসে, কেশবপুর, সেখান একে একটি অটোতে সাগরদাঁড়ি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িতে বেড়ানো। বেশ ভালো কাটল দিনটা। সারাদিনই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশ। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগল কপোতাক্ষ নদীকে দেখে। বেশ কিছু অংশ এতোটাই ভয়ঙ্কর ভাবে মজে গিয়েছে, ঠিক যেমন আমাদের ইতিহাস। একই ঘটনা ঘটে বারবার, শিক্ষা নিই না…কারণ প্রত্যেক স্মৃতিকে আমরা পলির তলায় চাপা দিতে ভালোবাসি।
সেদিনই সন্ধ্যায় ফিরলাম হোটেলে। পরের দিন সকালে রওনা দিলাম কুষ্ঠিয়া। ইতিহাসের আকর বলা যেতে পারে এই অঞ্চলকে। শিলাইদহের কাছারি বাড়িতে থেকেই জমিদারির কাজকর্ম সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ। আর এই সময়েই তাঁর কলম ছুটেছে দুরন্ত গতিতে। ঝোড়া হাওয়ায় উড়ে আসা পাতার মতো, জন্ম নিয়েছে অসাধারণ কবিতা, গান ও গল্প উপন্যাস। সে সব ইতিহাস কালো হরফে বন্দি।
এখানেই রয়েছে, লালন ফকিরের সমাধিস্থল। আর এই পুণ্যস্থানই, স্রেফ বাংলাদেশ নয়, অবিভক্ত বাংলায় সর্বধর্মের কাছেই এক তীর্থস্থান। বাউলের আখড়ায় লালনের গান এখনও ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে।..পাশেই পদ্মার শাখা নদী মধুমতী। মঙ্গলবেড়িয়া, কমলাপুর, টালিপাড়া, কালীশঙ্করপুর, আমলাপাড়া…আশে পাশের এলাকা দুদিনে প্রায় চষে ফেললাম।
কুষ্ঠিয়ার লজে বসেই পাঁচজনে ঠিক করলাম, ট্রেনে চাপবো। ৬ অগাস্ট বুধবার। রাত ১১.১০ এ ট্রেন। গন্তব্য গোয়ালন্দা ঘাট। সেখান থেকে ফেরি ধরে পদ্মা পার হয়ে পাটুরিয়া ফেরিঘাটে নেমে, সেখান থেকে বাসে ঢাকা যাওয়া। এখানে বলে রাখি, গোয়ালান্দা যাওয়ার কারণ কি? ওই যে প্রথমেই বললাম ইতিহাস।
১৮৭১ সালে পূর্ববঙ্গে কলকাতা থেকে গোয়াল্ন্দা পর্যন্ত রেল লাইন চালু করে ইংরেজরা। পদ্মার দক্ষিণে এই স্টেশন রয়েছে। এই গোয়ালান্দাই দীর্ঘ দিন ছিল অসম ও বাংলায় যোগাযোগের পণ্য পরিবহণের প্রধান কেন্দ্র। বাংলাদেশে নদীগুলি এমন ভাবে বয়ে গেছে, যেখানে সড়ক ও জলপথ পরিবহনই প্রধান। কলকাতা গোয়ালান্দার রেল যোগাযোগ ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরেও চালু ছিল। সেটা ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। পরে এই কেন্দ্রটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাতেই সীমাবদ্ধ হয়।
কিছুটা অ্যাভেঞ্চারের টানেই আমরা কুষ্ঠিয়া স্টেশনে না উঠে ট্রেন ধরার পরিকল্পনা নিলাম জগতি স্টেশন। বাংলাদেশের ম্যাপ বিচার করলে ইংরেজ আমলে এটি প্রথম রেল স্টেশন। তাহলে বুঝতেই পারছেন, কেন আমরা এই স্টশনকে ট্রেনযাত্রার সূচনা পর্ব হিসেবে বাছলাম।
সব কিছুই ঠিক ঠাক ছিল। আর এই স্টেশন থেকেই আমাদের যাত্রায় আর এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাহিনি জুড়তে শুরু করল। আর সেই কাহিনি যে আমাদের সঙ্গে কখন কী ভাবে জুড়ে গেছে প্রথমে আন্দাজ করতে পারিনি।
রাত ১০টা। চারপাশ পুরো শান্ত। বর্ষার কালো মেঘ আঁকড়ে ধরে রয়েছে। মাঝে মাঝে ঝড়ো শনশনানি হাওয়া। পুরো স্টেশনে চরিত্র বলতে আমরা পাঁচজন। আলো আঁধারির বিচার করলে, আঁধারির পরিবেশটাই বেশি..পুরো স্টেশনে গোনাগুন্তি হয় ২০টি ডুম লাইট জ্বলছে। ওয়েটিং রুমটিও ছোট, ইংরেজ শাসনকালে যা তৈরি হয়েছি, তারপর স্টেশন তেমন ভাবে যে সেজে ওঠেনি, বলাই বাহুল্য। তবে বর্ষাকালে, রাতের বেলায় স্টেশন চত্বরটি যে একটা গা ছমছমে ব্যাপার রয়েছে, তা না দেখলে বোঝানো যাবো না।
ছাতা নিয়ে শঙ্কু স্টশনে গেল পায়চারি করতে। ওই পরিবেশে যেন সময় আর কাটতে চাইছে না। মোবাইলে গেম খেলে, ম্যাগাজিন পড়া, কিছুই যেন মনস্থির হচ্ছে না।
শঙ্কু এসে খবর দিল, স্টেশন লাগোয়া একটি ঝুপড়ি আছে, সেখানে দোকানও আছে..কিছু নিয়ে আসি, এই পরিবেশে মুখ না চালালে ঠিক মজা আসছে না। সেই রাত নটায় খাবার খেয়েছি। বসে বসেই হজম। দু ঠোঙা করে মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে এলো শঙ্কু, সবার জন্য।
রাত ১১.২০। ট্রেনের কোনও পাত্তা নেই, অ্যানাউন্সমেন্টও নেই। ব্যাপারটা কী! দীপ গেল খবর নিতে। ফোনে বলল, খুলনার দিকে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে, ট্রেন আসতে দেরি হবে। ভোর তিনটে হতে পারে। আমাদের মাথায় হাত। মেঘের গর্জনটা যেন বাড়তে শুরু করলো, মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি। বৃষ্টির দাপট খুব না থাকলেও, হাওয়ার চোটে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যেন ফুঁসছে বর্ষা।
হাতের মুড়ি শেষ। কাজ নেইতো খই ভাজ, সময় কাটাতে মুড়ির ঠোঙা ছিঁড়ে খবর পড়তে শুরু করলাম। একটা হেডিং চোখে পড়ল, কুষ্ঠিয়া স্টেশনে এক শিশুসহ দম্পতির লাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু। কবেকার কাগজ কে জানে, মাস্ট হেডের অংশ ছিল না তাই তারিখও বোঝা গেল না। তবে খবরটি মর্মান্তিক। লাইন টপকে স্টেশনে উঠতে গিয়ে বাচ্চাটি মায়ের কোল থেকে পড়ে যায়, তাকে তুলতে যাওয়ার সময়ই ট্রেন ঢুকে পড়ে স্টেশনে।
বেশ কিছুক্ষণ গেল, এই বৃষ্টির মধ্যে আমাদের পাঁচ জনের সঙ্গে যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা বাড়ল। এক বছর ছয়েকের একটি বাচ্চা আর তাঁর বাবা। ভদ্রলোকের চেহারা বেশ ছিপছিপে, বয়স ৪০ হবে, তবে শরীরে ছাপ দেখে মনে হয় ৫০। তাঁর স্ত্রীও বেঁটেখাটো, কালো মাথায় ঘোমটা। বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় আসতে গিয়ে তিনজনেই ভিজে গিয়েছে। ভদ্রলোক মুখে হাসি মুখে আমাদের জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন? আমরা কিছুটা সন্দেহর চোখে বললাম, এই ঢাকা যাবো। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, বাংলাদেশ বেড়াতে। কুষ্ঠিয়া বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল, তাই ঘুরে দেখলাম আরকি।
এতো প্রশ্নের উত্তর ইচ্ছে করেই দিলাম, কারণ জানতাম একের পর এক প্রশ্নগুলো আসবে। ভদ্রলোক আর কোনও প্রশ্ন না করে একটা অদ্ভুত কথা বললো। ঘোরেন ঘোরেন, দেখবেন অনেক কিছুই দেখা। এই বলে তিনি নিজের কথা বলতে শুরু করলেন, তিনি যাবেন খুলনা, তাঁর শালা মারা গিয়েছেন, শ্রাদ্ধবাড়িতে যাচ্ছেন। নেহাত একটাই শালা তাই এই বর্ষাতে যাওয়া, বিয়েবাড়ি হলে তিনি আদৌ যেতেন না।
ভদ্রলোক যতটা কথাবার্তায় মিশুকে দেখলাম, তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে সম্পূর্ণ উল্টো। এক দৃষ্টে শুধু বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকি রয়েছে। দুজনেই যেন পাথর।…
ভদ্রলোক ফের আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের ট্রেন কটায়? আমি বললাম, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ছিল, কিন্তু ভোর তিনটেতে আসবে। ভদ্রলোক বললেন আমার ট্রেন সকাল সাতটায়।
আমি প্রশ্ন করতে যাবো, সাতটায় ট্রেন আর আপনি এখন থেকে…তার আগেই, তিনি নিজের মুখে আঙুল দিয়ে আমাকে ইশারায় বোঝালেন, চুপ, কোনও কথা নয়।..বললেন, এখন আমাদের রেস্ট নেওয়ার পালা। বলে তিনজনের তিনটি বেঞ্চে শুয়ে পড়লেন। এই অদ্ভুত আচরণে আমরা পাঁচজনেই স্তম্ভিত, নিজেদের মধ্যে মুচকি হাসলাম।
ভোর তিনটে পাঁচ। ট্রেন ঢুকলে। কামরা প্রায় ফাঁকা, আলো নেই। টর্চ জ্বেলে প্রায় পুরো কামরাই নিজেদের মতো দখল করলাম। এমন পরিস্থিতিতে ঘুম যেন পথ হারিয়েছে…পাঁচ জনেই, একটি এমার্জেন্সি জ্বেলে, তাস খেলার পর্ব শুরু করলাম। কিন্তু ট্রেন ছাড়ল না। বৃষ্টির দাপটটা যেন ক্রমেই বাড়তে শুরু করল। দরজার সামান্য দরজা খুলে স্টেশন চত্বর দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দশ ফুট দূরত্বে কী রয়েছে বোঝার উপায় নেই। স্টেশনে ওই ভদ্রলোকের কথা মনে হচ্ছিল, তিনজনেই ঘুমোচ্ছিল, তাই ট্রেনে ওঠার আগে আর ওদের ডিসটার্ব করতে ইচ্ছে হয়নি।
প্রায় ২০ মিনিট বাদে, ট্রেন ছাড়ল। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছালাম কুষ্ঠিয়া স্টেশন। তুলনামূলক ভাবে স্টেশনে লোকের ব্যস্ততা রয়েছে। কিন্তু ট্রেন ইঞ্জিনের কাছে যেন কেমন জটলা। সিগন্যাল রেড হয়ে আছে…অগ্নি দেখতে গেল ব্যাপারটা কী?
কয়েক মিনিটের মধ্যে দৌড়তে দৌড়তে এসে অগ্নি আমাদের যেটা বললো, তা শুনে আমার মাথা থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
অগ্নির কথায় জগতি স্টেশনে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, একদম হুবহু, সেই ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী এবং একটি ছ বছরের মেয়ে কাটা পড়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগে বাচ্চাটি পা পিছলে পড়ে যায়, তাকে তুলতে গিয়েই তিনজনে কাটা পড়ে।…
পুরো ঘটনাটাই তালগোল পাকাতে শুরু করে। ভদ্রলোকের যাওয়ার কথা খুলনা অর্থাৎ দক্ষিণে আর আমরা যাচ্ছি উত্তরে।…দীপ বললো, ট্রেনে কাটা পড়লে অনেকের শরীর বিকৃত হয়ে যায়, আর পোশাক ও স্ত্রী কন্যা থাকা বিষয়টা কাকতালীয় হতে পারে। কারণ এটা হতে পারে না, যাদের জগতি স্টেশনে দেখেছি, তাদেরই লাস কুষ্টিয়া স্টেশনে থাকবে। ওরা নিজেরা নিজেদের মতো যুক্তি, পাল্টা যুক্তি সাজালেও, আমার কাছে পুরো বিষয়টাই খটকা লাগছিল। আর সেই খটকায় কেমন যেন শিলমোহর বসালো যখন আমরা পৌঁছালাম চরাইকাল স্টেশনে।
বর্ষার দাপটে, ট্রেনের গতিও বিপর্যস্ত। রাতভোর ট্রেন বেশ কিছু স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। কত লোক উঠেছে নেমেছে, তবে ট্রেনে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠার ভিড় হয়নি। যেটা হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি ছিল।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে মেঘলা আকাশ। মনে মনে কেমন একটা অশুভ সঙ্কেত দিচ্ছিলই, সেই সঙ্গে মনে হচ্ছিল প্রবল বর্ষায় পদ্মা হয়তো ফুঁসছে। ফেরি পার করতে হবে। কী হবে কে জানে। ট্রেন ঢুকলো, চরাইকাল স্টেশন। তখন সকাল ৬.৩০।
কিছু লোক উঠলো বটে কিন্তু ভিড় প্রায় নেই বললেই হবে স্টেশনে। স্থানীয় দু এক জনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বর্ষার কারণেই ভিড় কম।
আর ট্রেনে মানুষ যায় নিরুপায় না হলে, বাস আর ফেরি ব্যবস্থাই বাংলাদেশের লাইফলাইন। স্টেশনে নামলাম আমি, অগ্নি আর দীপ। স্টেশন চত্বরে কোনও খাবারের দোকান নেই। কিছু দূরে দেখলাম একটা হকার রয়েছে। তার কাছেই চা আর বিস্কুট নিলাম। সেই বলল, ট্রেন ছাড়তে প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে।
কুমারখালি স্টেশনের কাছে, লাইন ডুবে গেছে। অগত্যা মনে কিছুটা সাহস পেয়ে গেলাম ট্রেনচালকের কাছে। সেও বললো, কম করে এক ঘণ্টা লাগবে। রাত থেকেই এই গণ্ডগোল, রুট রিলের সিগন্যাল ব্লকেজ হওয়ায়, খোকসা, মাছপাড়া, পাংসা কালুখালি জংশনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
বুঝলাম কপালে ব্যাথা আছে, তাই সময় নষ্ট না করে, স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে গেলাম কিছু খাবারের খোঁজে। জানিনা, গোয়ালন্দ কখন পৌঁছব? বা সেখানে কী বিপদ অপেক্ষা করছে। প্রায় নটি স্টেশন অতিক্রম করলে গোলন্দ ঘাট স্টেশন। দূরত্ব খুব বেশি না হলেও, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সেই দূরত্ব বাড়িয়ে তুলেছে।
স্থানীয় দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার, চিড়ে, মুড়কি, মুড়ি, বাতাসা, নকুলদানা, আর বাদাম চানাচুর নিয়ে এলাম। এটাই লম্বা সফরে আমাদের খোরাক। ট্রেনে ফিরে বসে আছি, কিছু খাওয়া দাওয়া সারলাম। আর আমার হাতেই যে ঠোঙাটি ছিল। তারই হেডিঙে চোখ পড়ল।
গোয়ালন্দে-পাটুরিয়া ফেরি পারাপারের সময় নৌকাডুবি, মৃত ২০, নিখোঁজ অন্তত ৭০। এটা দেখেই হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছুটা মুড়ি ছিল ঠোঙাটা পাকিয়ে সোজা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। অগ্নি জিজ্ঞেস করলো, কী হল? আমি কী উত্তর দেবো, ভেবে পেলাম না, বললাম, ভালো লাগছে না। প্রায় সাড়ে আট টা নাগাদ ট্রেন ছাড়ল। মনে হচ্ছিল একটি কচ্ছপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে এবং কে সবচেয়ে দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছয় তারই প্রতিযোগিতা।
তখনই মনে হচ্ছিল, আমাদের প্ল্যান অনুসারে বাংলাদেশ ঘুরতে হলে, প্রায় ছ মাস লাগবে। অবশ্য কিছুই করার নেই। আমাদের ভারতেও প্রবল বর্ষণ হলে, রেল কর্তারা ট্রেন বাতিল করতে ওস্তাদ। বাংলাদেশ সফরে অবশ্যই সেই চিত্রটা ছিল না। বিকেল তিনটে নাগাদ পৌঁছালাম গোয়ালন্দ স্টেশনে। এখান থেকে রিক্সা ধরে গোয়ালন্দ ফেরিঘাট।
গোয়ালন্দ ঘাট ঢোকার আগেই চোখে পড়েছিল রাজবাড়ি স্টেশন। এখানে বলে রাখি, এই রাজবাড়ি একটি জেলাও বটে। এটি এর আগে ছিল ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত। এখানে একটি বড় জমিদার বাড়িও রয়েছে, মূলত সূর্যকুমারের হাত ধরেই এখানকার রাজবাড়ির সূচনা। তবে এর ঐতিহ্য এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যা আছে ইতিহাসের পাতায়।
গোয়ালন্দঘাটে পৌঁছতে সরাসরি মাথায় বাজটা পড়ল। প্রবল বর্ষায়, একটি নৌকাডুবি হয়েছে, কিছুক্ষণ আগে, তাই ফেরি সার্ভিস বন্ধ। গোয়ালন্দ ঘাট থেকে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের দূরত্ব অনেকটাই।
পদ্মা এখানে ব্যাপক চওড়া, তার মূল কারণ, ঢাকার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে একদম সোজা সিলেট, ওদিকে ভারতের মেঘালয়। আর পূর্ব দক্ষিণ কোন বরাবর ঢাকা। বাঁ হাতে পড়বে নাটোরের দিক। আর এই দিকেই ব্রহ্মপুত্র নদ এবং পদ্মা এসে মিশেছে। ফলে আন্দাজ করা যায়, দুটি বড় নদীর সঙ্গম স্থলের প্রসার ঠিক কতটা হতে পারে। আর বর্ষায় এই দুই নদ নদীর দাপট কতটা দুরন্ত হয় না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
কিছু করার নেই, প্রায় অসহায়ের মতো, প্রায় ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে ফেরি ঘাটের কাছে।
দু একটি লোক ঘোরাফেরা করছে, আর আমরা পাঁচজন। আজ ফেরি নেই, কাল কপাল ভালো হলে, ফেরি চলবে। আর নৌকাডুবির কারণে সরকার ফেরি সারর্ভিস অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করলে হয়ে গেল। সেই সময় মনের মধ্যে এমন নানা আজগুবি চিন্তা ভর করছে। আর এই ভাবনার মাঝের ঝোড়ো হাওয়ার মতো ভেসে উঠছে, চরাইকল স্টেশনে মুড়ির ঠোঙার কথা। নৌকাডুবি। জগতি স্টেশনের ঘটনার পর এটা দ্বিতীয় কাকতালীয় ঘটনা।
গোয়ালন্দঘাটে এক অদ্ভুত আবহাওয়া, পরিবেশটাও যেন বড্ড ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, প্রকৃতির এমন কাল রূপ আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। আমার আত্মবিশ্বাস কেমন তলানিতে যেতে শুরু করলো। বারবার মনে হচ্ছিল, আমরা কি কোনও বিপজ্জনক ঘটনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? নাকি কোনও বিপদ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে? সন্ধে নেমে এলো…রাজেন আর শঙ্কু গেল রাত কাটানোর বন্দবস্ত করতে। আমি, অগ্নি আর দীপ তখন চুপচাপ… বসে আছি পদ্মার পাড়ে। ফুঁসছে পদ্মা, প্রবল স্রোত যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কতটা ভয়ঙ্করী, আর ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের সামনেও সমুহ বিপদ।
৮ অগাস্ট শনিবার। বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। বনানি স্টেশন ও বাস স্ট্যান্ডের কাছেই একটি হোটেল নিয়েছি। হোটেল প্যাসিফিক। গোয়ালন্দ থেকে ঢাকা শহরে ঢুকতে আমাদের পাঁচ জনের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছি। কী ধকলটাই গেছিল। এখনও ভাবলে গা শিউরে ওঠে। যশোর সফর বাদ দিলে, কুষ্ঠিয়া থেকে ঢাকা সফরে আমাদের কী নাজেহাল অবস্থা হয়েছে, তা হয়তো ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।
গোয়ালন্দায় নৌকাডুবির ঘটনায় ফেরি সার্ভিস বন্ধ হওয়ায়, অপরিকল্পিত ভাবে আমাদের রাত কাটাতে হয় ওখানে। সেটাও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সন্ধে নামার পর রাজেন আর শঙ্কু এসে খবর দিয়েছিল, ওখানে হোটেল বা লজ তেমন নেই। তবে স্থানীয় একজনকে বলে, তাদের বাড়িতে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়। অগত্যা আমরা গিয়েছিলাম, স্থানীয় এক বাসিন্দা নাজমুল হাসানের বাড়িতে। নাজমুল নিম্নবিত্ত হলেও, অতিথি আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেনি।
রিক্সা ধরে নেমেছিলাম দৌলতদিয়া পুলিশ স্টেশনের কাছে। সেখান থেকে টার্মিনাল রোড ধরে আলো আঁধারি রাস্তা পার করে, একটা বস্তিতে পড়লাম। বাড়িগুলো অদ্ভুত…প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ি টিনের দেওয়াল, টালির চাল। টিনের দেওয়ালের বাড়ি আমি কখনও দেখিনি। নাজমুলের বাড়িতেই রুটি আর চিকেন দিয়ে নৈশভোজ সারা হল।…পরের দিন, সকালে শুনলাম ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে।
আর অপেক্ষা নয়। গোয়ালন্দ থেকে রওনা দিলাম। আসার পথে শঙ্কুর কাছে শুনলাম, আমরা যেখানে রাত্রিবাস করেছি, সেটা ছিল বাংলাদেশের বিখ্যাত বলা ভালো কুখ্যাত যৌনপল্লী। কথাটা শুনেই, আমি স্তম্ভিত হয়ে গেল। নাজমুলের বাড়িতে যাওয়া, রাত্রিবাস পুরোটাই কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্মৃতিতে ভরা ছিল। আশে পাশের দৃশ্য কিছুই মাথায় রেজিস্ট করেনি। আসলে চিন্তায় ছিলাম আমরা ঢাকা কী করে পৌঁছবো।
পাটুরিয়া পৌঁছে, অটোতে মানিকগঞ্জ, সেখান থেকে বাসে ঢাকা পৌঁছই। এক অসাধারণ, অদ্ভুত, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, যা আমার জীবনে প্রথম। ঢাকাতে হোটেলে উঠে প্রথম দিনটা ভালোই কেটেছে, প্রায় তিন দিনের ঘুমের একটা বড় ডেফিজিট ছিল, সেটা যেন এক দিনেই কেটে গেছে।
ইচ্ছে ছিল দুটো দিন ঢাকা কাটিয়ে যাবো চট্টোগ্রাম, কক্সবাজার। দেখবো, বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সমুদ্র সৈকত। সন্ধে নাগাদ পাঁচ জনেই বেরোলাম, গুলশন এলাকায়। মাঝে একটা রাস্তা পেলাম, কামাল আতাতুর্ক সরণি। নামটা দেখেই বিস্মিত হলাম। কামাল আতাতুর্কের নামে এখানে রাস্তা! কামাল আতাতুর্ক নামটার সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নন। কিন্তু সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি জগত বিখ্যাত। মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক ছিলেন তুরস্কের সেনা আধিকারিক।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, ব্যাপক পরিবর্তন আসে তুরস্কে, সেই সময় তিনি ছিলেন সেনার পদস্থ কর্তা। অটোমান সাম্রাজ্য ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর, তাঁর নেতৃত্বে তুরস্ক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। শুধু তাই নয়, তুরস্ক ইসলামিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর প্রচেষ্টাতেই দেশটির সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জায়গা করে তুরস্ক। এ ছাড়া নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা সব দিক থেকে তিনি পাশ্চাত্যের ভালো দিকগুলিকে নিয়ে দেশের নীতি নির্ধারণ শুরু করেন। তিনি নিজে ইসলাম ধর্মালম্বী হয়েও, দেশের সংবিধানে এই ধর্মকে কোনও বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেননি। আর তার ফল এখন পাচ্ছে সারা দুনিয়া। এবং তুরস্ক এশিয়া ও পাশ্চাত্যের কাছে একটা বড় উদাহরণ।
গুলশন এলাকাতেই, পায়চারি করার সময়ই শুনলাম, গুদারাঘাটে, শাহী মুড়ির একটা দোকান আছে, অসাধারণ নাকি বানায়, শোনামাত্রই, সেখানে হানা দিলাম পাঁচজন। নানা রকম জিনিস দিয়ে বানানো শাহী মুড়ির টেস্টটাই যেন মাখনের মতো। দামটা একটু বেশি গেল বটে, কিন্তু সেই স্বাদ অনবদ্য।
হোটেলে ফেরার সময়, ফুটপাথের একটা দোকান থেকে কিছু জিলিপি নিলাম। ফের একবার চোখ পড়ল ঠোঙার দিকে। খাগড়াছড়িতে চার ভারতীয় পর্যটকের দেহ উদ্ধার, পুলিশের অনুমান, দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যু। এটা দেখার পরেই গা গুলিয়ে উঠল। প্রায় হন্তদন্ত হয়ে হোটেলের উদ্দেশে রওনা দিলাম। এদিনের সন্ধ্যায় বৃষ্টির লেশ না থাকলেও, আবহাওয়া ঠান্ডাই ছিল, তবু হঠাৎ করেই যেন দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম। আর মনের মধ্যে নিশ্চিত ছিলাম, এই দুর্ঘটনা আমাদের সঙ্গেই ঘটতে চলেছে।
রুমে ফিরে প্রায় গুম মেরে গেলাম। আমার রুমে ছিল শঙ্কু আর রাজেন, আর পাশের রুমে, দীপ আর অগ্নি। রাতে আমি আর কিছুই খেলাম না। ওরা চারজনে রেস্তরাঁয় খাবার খেয়ে এলো। খেয়ে ফেরার পর, ওরা যেটা বললো তা শুনে আমার শরীর পুরো পাথর হয়ে গেল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, কসক্সবাজার, চট্টোগ্রাম, আর ওরা প্ল্যান করেছে খাগড়াছড়ি। এই প্ল্যানে পুরোপুরি আপত্তি জানালাম আমি। কিন্তু চারজনেই বেঁকে বসলো। বললো, আমাদের হাতে সময় আছে, খাগড়াছড়ি থেকে ফেরার পথে চট্টোগ্রাম ঢুকবো।
এবার আমি ওদের পুরো কথা খুলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। জগতি স্টেশন থেকে গুলশনের রাস্তায় মোট তিনটি ঘটনা, আর তিনটি ঘটনার ইঙ্গিত এসেছে ঠোঙার মোড়কে। যেটা পড়েছি, আর সেটাই হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে আমাদের সঙ্গেই। আর পাঁচজনের মধ্যে কেউ একজন বেঁচে থাকবো। আর এই ইঙ্গিত পাওয়ার পর আমি ঝুঁকি নিতে পারবো না।
আমার কথা শুনে, চারজনেই আমাকে নিয়ে রসিকতা শুরু করলো। তাদের হাসি থামছিল না, যেন আমি তৃতীয় শ্রেণির কোনও কমেডি করেছি। কিছু রেগেই আমি বললাম, ঢাকা ছেড়ে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না, আর কাল রাতেই বেনাপোলের বাস ধরবো, আর হ্যাঁ, তোরাও কথাও যাচ্ছিস না, আমি সঙ্গে কলকাতায় ফিরছিস। আমার এই প্রচ্ছন্ন হুমকি শুনে, ওরা মুচকি হেসে ঘরের বাইরে গেল। ওদের শরীরে ভঙ্গি বলছিল, কিছু একটা প্ল্যান করছে, কিন্তু সেটা কী প্ল্যান আমি ভেবেও কোনও সূত্র পেলাম না।
রাতের দিকে, হোটেল রুম থেকেই মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম, ফের বৃষ্টি আসবে হয়তো, এই ভাবা, আর বৃষ্টি এলো ঝেঁপে। হোটেলের জানলা থেকে ঢাকা শহরের দিকটা দেখলাম, আলো আঁধাারি পরিবেশে, জলের ঝাপটায় যেন মুহুর্মুহু ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে শহরটাকে। ব্যস্ত গতিময় জীবনকে যেন থামিয়ে দেওয়ার প্রবল চেষ্টায় রয়েছে, লাগামছাড়া বৃষ্টি।
শঙ্কু আর রাজেন একটা খাটে ঘুমিয়ে পড়েছে, একটা ডিম লাইটকে সঙ্গী করে আমি নিশাচর হয়ে বসে আছি, ঘুম আসছে না। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেন এক পা করে এগোচ্ছি মৃত্যুর প্রহেলিকায়। আমিতো জানি, ইঙ্গিত পাচ্ছি, কিন্তু ওরা কিছুই বোঝার চেষ্টা করছে না। ভোর তিনটে নাগাদ শরীরে একটা অদ্ভুত ক্লান্তি এলো, গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
সকাল নটা, সার্ভিস বয়ের দরজায় টোকা মারার শব্দে ঘুম ভাঙলো। পাশের বেডে শঙ্কু আর রাজেন নেই। হয়তো মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে। দরজা খুলতেই, ব্রেকফাস্ট দিল ছেলেটি। প্রায় ঘণ্টা খানেক কাটার পর আমি গেলাম রিসেপশনে। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম ওরা কোথায় গেছে কিছু বলে গেছে কিনা।
যে ভাবনাটা আমার মাথাতে একদমই আসেনি, ঠিক সেটাই হয়েছে, আজ পর্যন্ত আমাদের হোটেলের বিল মিটিয়ে ওরা চারজন চলে গিয়েছে। আর আমার জন্য মেসেজ ছেড়েছে, দু দিন বাদে চট্টোগ্রাম ঢুকবো, সেখানে যেন আমি চলে যাই, খাগড়াছড়িতে আমি যাওয়ার পক্ষে ছিলাম না, তাই ওরা আমাকে সঙ্গেও নেয়নি।
বিষয়টি জানার পর মেজাজটা গেল সপ্তমে চড়ে। নিজের ওপরেই এতো বিরক্ত বোধ করছিলাম যে…ঠিক করলাম দুটো দিন ঢাকাতেই থাকবো। সত্যি কথা বলতে কি আমার হাতে আর অপশনও ছিল না।
আগের দিন রাতে গুলশন এলাকা থেকে আমরা চারজনে চারটে সিমকার্ড কিনেছিলাম। কিন্তু নিজেদের নম্বরগুলো এক্সচেঞ্জ করা হয়নি। ফের দৌড়লাম গুলশনের ওই ফোনের দোকানে, যেখানে সিমকার্ড কিনেছিলাম। কিন্তু কি জানি কেন ওই দোকানটিকে আর খুঁজে পেলাম না, দোকানের নামটাও মনে পড়ছে না। প্রায় হতাশা নিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
কিছুই ভালো লাগছে না, মন মেজাজ পুরো খারাপ, মনে হচ্ছিল একটা ব্যস্ত শহরে থাকলেও, যেন কেউ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, শেষবারের মতো দেখা হলে, সরাসরি বলবো, ভাই তোদের সঙ্গে এই শেষ সম্পর্ক। রুমে বসে টিভি চালালাম, চ্যানেল বদলাচ্ছি, কিছুই ঠিক লাগছে না, ভালো লাগছে না।
কিছুক্ষণ ইন্টারনেট ঘাঁটলাম, ইউটিউব দেখলাম, সিনেমা দেখে মন ঠিক করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও ভাবেই মনটাকে বাগে আনতে পারছিলাম না। ঘোরের কোনে দেখলাম কিছু পেপার জমে আছে। সেগুলো নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করলাম। সত্যিতো, ১ অগাস্ট থেকে একবারও পেপার দেখা হয়নি। পেপারগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে ১ অগাস্টের পেপারও পেলাম। পুরনো খবরই দেখি, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখি বিদেশের পাতা। সেখানে একদম ডানদিকের একটি কলমে একটি খবর চোখ টানলো। কলকাতায় বাস ট্যাক্সির সংঘর্ষ, মৃত ১০।
অর্থাৎ আমরা যেদিন বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিই, সেদিনই ঘটনাটা ঘটেছে!
এবার ঢুকলাম বিস্তারিত খবরে, পুরো খবরটা পড়তেই, আমার সারা শরীর পুরো হিম হয়ে উঠল, নড়ার কোনও ক্ষমতা নেই। মনে হতে লাগল, একটা বড় রোলার যেন আমার সারা শরীর দিয়ে বারবার যাতায়াত করছে। সেদিনে পেপারে যে খবরটি পড়েছিলাম, তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হল।
অখিলবন্ধু খোন্দকার, কলকাতাঃ ১ অগাস্ট। একটি মিনিবাস ও ট্যাক্সির সংঘর্ষে প্রাণ গেল ১০ যাত্রীর। আহত ২০। ঘটনাটি ঘটেছে, নিউ মার্কেট থানা এলাকার লেনিন সরণিতে।
এদিন সকালে হাওড়া থেকে শিয়ালদহগামী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে ওভারটেক করতে থাকা একটি ট্যাক্সিকে। ট্যাক্সিটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাথে উটে যায় এবং সজোরে ধাক্কা মারে একটি দোকানে। ট্যাক্সিটিতে চালক ছাড়া চারজন যাত্রী ছিল। এদিকে বাসটিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বাসের খালাসির, বাসচালক পলাতক।
বাসের ২০ জন যাত্রীকে স্থানীয় এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গেলে ১০ জনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়, আহতদের চিকিৎসা চলছে।
অন্য দিকে, ট্যাক্সির চালক ও চার যাত্রীরই মৃত্যু হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও বাংলাদেশের ভিসা উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত চার ট্যাক্সিযাত্রীর নাম। দীপ বসু (৩৬) রাজেন কর্মকার (৩৫) শঙ্কু দেবরায় (৩৬) এবং অগ্নি দাশগুপ্ত (৩৭)। পুলিশের অনুমান এই চারজন বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার জন্যই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।