পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- বিশ্বের মধ্যে অতুলনীয় এক দেশ ভারত। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ তার গাথা। ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান ও বিবিধ সংস্কৃতির এক অন্য পীঠস্থান যা সারা বিশ্বের আর কোথাও, কোনও অঞ্চলে উপস্থিত নেই। তাই হয়তো শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ব্যসদেব বলেছিলেন মহাভারতের সূচনা পর্বে, যা আছে ভারতে, তা আছে মহাভারতে।আজ থেকে আমরা শুরু করছিল ভারতের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ইতিহাসের, পুরাণ ও মহাকাব্যের সেই মহাযাত্রা যা আপনার ভারত দর্শন তথা সারা বিশ্বদর্শনের সমতুল।ধারাবাহিক পর্ব শুরু হবে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ দিয়ে। আজকের পর্বে থাকছে, সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ।
ভারতের হিন্দু সংস্কৃতি বা ধর্মে যে পবিত্র তীর্থস্থলের কথা বলা রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ। আর এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম সোমনাথ। যা গুজরাটের সৌরাষ্ট্রের অবস্থিত। ভারতের পশ্চিমের পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় বহুবার বহিঃশত্রু দ্বারা এই মন্দির আক্রান্ত হয়েছে মূলত ভারতে যতগুলি ইলসামিক খিলাফতি শাসন ব্যবস্থার শাসকরা ভারতে ঢুকেছেন, ততবারই সবার আগে এই ধর্মীয় স্থল আক্রান্ত হয়েছে। ফলে তৈরিও হয়েছে দফায় দফায় বিভিন্ন সময়ে। আধুনিক যে মন্দিরটি দেখা যায়, সেটি তৈরি হয় ১৯৫০ সালে ।
এটির উদ্বোধন করেছিলেন সেই সময়ের দেশের রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ।কিংবদন্তি।এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে নানা কিংবদন্তি ও পৌরাণিক গল্প। এখানেই নাকি রাখা ছিল সামন্ত্যক মণি বা পরশপাথর। যে পরশপাথরের ছোঁয়ায় যে কোনও ধাতু হয়ে উঠত সোনা। আর এই মণির উপরেই বিরাজ করত শিবলিঙ্গ। ফলে জলের তোড়ে অন্য কোথাও ভেসে যেত না, স্থির থাকতো। ঐতিহাসিক সূত্রেও মিলে রয়েছে কিংবদন্তি। সুলতান সাবুক্তাগিনের পুত্র মামুদ ভারতে আক্রমণ শানায়। সময়টা ১০২৫ খ্রিঃ এবং জোরকদমে ধর্মান্তকরণে মরিয়া হয়ে ওঠে।
ভারতের বিচ্ছিন্ন সামন্ত রাজারা তখন প্রায় ছন্নছাড়া দশা। সেই সময় বহু মানুষ এই মন্দিরে আশ্রয় নেয়, প্রাথর্না জানাতে থাকে। মন্দিরকে রক্ষা করেই বহু হিন্দু ধর্মালম্বী যুদ্ধে সামিল হয়, সেই যুদ্ধে মারা যায় ৫০ হাজার মানুষ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মন্দির দখলে যায় সুলতানের। মন্দিরের প্রচুর ধনসম্পত্তি, সোনা, রূপো, হীরে সব লুঠ করা হয়, তছনছ করা হয় মন্দিরকে। মন্দিরের মূর্তিখুলতে গিয়ে সুলতানের আগ্রাসী সৈন্যরা দেখতে পান, মহাদেবের মূর্তি শূন্যে ভাসছে। বিষয়টি প্রাথমিক ভাবে অবাক করলেও, সৈন্যের একাংশ পরীক্ষা শুরু করে।
তারা বুঝতে পারে, মূর্তিটি লোহার ছিল এবং যেখানে ঝুলছে, সেই আর্চে পাথরের পাতলা আস্তরণের পিছনে ছিল চুম্বকের বিম। স্থাপত্যের মধ্যে চুম্বকের অত্যাশ্চর্য ব্যবহারের কারণ অনেকেই সেভাবে রহস্যভাদ করতে পারেনি। যদিও কিছু স্থপতিদের মত, বাস্তুর মধ্যে চুম্বকের ব্যবহার করলে বজ্রাঘাত, বা অভ্যন্তরিণ পাথরের পিলারগুলিকে অনেক শক্তিশালী করে তোলা যায়।সোমনাথ মন্দিরের কথা বেদ ও পুরাণেও রয়েছে। শ্রীমদভাগবত গীতা, স্কন্দপুরাণ, শিবপুরাণ এবং ঋগ বেদেও এই মন্দিরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা রয়েছে।
এই মন্দির অঞ্চলকে অনেকে ত্রিবেণী বলেও মনে করেন। কারণ তিনটি নদীর সঙ্গমস্থাল, কপিলা, হীরণ এবং সরস্বতী। পৌরাণিক কিংবদন্তি, সোমনাথ আসলে চন্দ্রদেব। তাঁর ২৭টি স্ত্রী ছিল, প্রত্যেকেই দক্ষরাজের কন্যা। চন্দ্রদেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাঁর স্ত্রী রোহিনী ছাড়া বাকি স্ত্রীদের প্রতি তাঁর কোনও নজর বা গুরুত্ব ছিল না। এটা জানার পরেই দক্ষরাজ চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দেন। তিনি বলেন, চন্দ্রের যে জ্যোতি রয়েছে তা হারিয়ে যাবে।
এর পরেই প্রজাপতি ঋষি ব্রহ্মার পরামর্শে চন্দ্রদেব মহাদেবের উপাসনা শুরু করেন। মহাদেব তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে, তাঁকে তাঁর জ্যোতি নতুন করে দান করেন। পৌরাণিক গাথা মতে, এই চন্দ্রদেবই প্রথম স্বর্ণমন্দির তৈরি করেন এখানে।পৌরাণিক সূত্র গবেষণার করে দেখে গিয়েছে, এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল শ্রাবণ মাসের তৃতীয় দিনে দশম ত্রেতা যুগে। শ্রীমদ, অধ্য জগতগুরু শঙ্করাচার্য় বৈদিক গবেষণা সংস্থানের চেয়ারম্যান, স্বামী শ্রী গজানন্দ সরস্বতীর মত, স্কন্দপুরাণের সূত্র ব্যাখ্যা করলে পাওয়া যায়, এই মন্দির তৈরি হয়েছিল প্রায় সাত কোটি বছর আগে।
যা আধুনিক সময়ে অবিশ্বাসযোগ্য। ১০২৫ সালে গজনীর সুলতান মামুদ ভারত আক্রমণ করে, লন্ডভ্ন্ড করা হয় মন্দিরকে। তারপর মালবার রাজা ভোজ এই মন্দির নির্মাণ করেন। সোলাঙ্কির রাজা প্রথম ভীমদেব তিনি মন্দির নির্মাণে সাহায্য করেন। প্রথমে মন্দিরটি ছিল কাঠের পরে, সেটিকে পাথরের করা হয়। সেটি করিয়েছিলেন রাজা কুমারপাল।১২৯৬ সালে আলাউনদ্দিন খিলজির সেনা আবার মন্দিরের উপর ধ্বংলীলা চালায়। সেই সময় গুজরাটের রাজা ছিলেন করণ।
তাঁকে হারিয়ে গদিচ্যুত করে হত্যা করা হয়। ১৩০৮ সালে এই মন্দির পুর্ননির্মাণে হাত দেন, সৌরাষ্ট্রের চহ্বান রাজা মহিপাল দেব। সেখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন মহিপালের পুত্র খেঙ্গার। ১৩২৬ থেকে ১৩৫৬ মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৩৭৫ সালে এই মন্দিরে ফের আক্রমণ শানায় মুজাফফর শাহ। স্থাপন হয় গুজরাট সালতানাত।য ১৪৫১ সালে ফের মন্দির আক্রান্ত হয় মেহমুদ বেগাড়া, গুজরাট সালতানাতের সুলতান।ভারতের মুঘল শাসন শুরু হওয়ার পর এই মন্দির কার্যত ধ্বংসস্তূপই ছিল।
কিন্তু ঔরঙ্গজেবের আমলে এই ধ্বংসস্তূপকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া এবং নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সেই সময়, পুণের পেশোয়া, নাগপুরে ভোঁশলে রাজা, কোলাপুরের ছাত্রপতি ভোঁশলে ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকার এবং গোয়ালিওরের শিন্ডে রাজা শ্রীমন্ত পাতিলবুয়া সংঘবদ্ধ হয়ে মুঘল সেনাকে নাস্তানাবুদ করে। এবং ১৭৮৩ সালে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করে।বর্তমান মন্দিরে যে স্থাপত্য দেখা যায়, তা চালুক্য স্থাপত্যরীতি বা কৈলাস মহামেরু প্রসাদ কুশলরীতি।
আরও পড়ুন- ভারতের প্রাচীন অজেয় দেবগিরি কেল্লার ইতিহাস (ভিডিও প্রতিবেদন)
ভারতীয় পুরাণে বেশ কিছু স্থাপত্য কৌশলের কথা বা বাস্তুরীতির কথা বলা আছে, তার মধ্যে অন্যতম বাণস্তম্ভ। বা অ্যারো পিলার। সেই নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে মূলত মন্দিরের পশ্চিমতটে কারণ সেদিকেই রয়েছে সমুদ্র। নির্মাণ কৌশলে উত্তর ও দক্ষিণমেরুর দ্রাঘিমাংশরেখার সঙ্গে মিলিয়ে বাণস্তম্ভ প্রস্তুত করা হয়েছে। যে এই স্থাপত্য মেলাতে বৈদিক বাস্তু গণিতের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।পুরো মন্দির জুড়ে রয়েছে, ভারতীয় প্রাচীন স্থাপত্য রীতির ছাপ, যা প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রের গণিতকে মাথায় রেখেই নকশা করা হয়েছে।