Breaking News

নরখাদকদের দেশ, কীভাবে বদলে গেল! পর্যটনের নিরিখে চোখ টানছে দুনিয়ার

স্বাতী চট্টোপাধ্যায়– একটা আস্ত মানুষকে টুকরো টুকরো করে কেটে খেয়ে ফেলছে একদল মানুষ। বিষয়টা ভাবলেই সারা শরীর কেমন শিউরে ওঠে, কিন্তু এই দৃশ্য যদি চোখের সামনে ঘটে! তাহলে অনেকেই হয়তো জ্ঞান হারাবেন। সারা বিশ্বে এমন অনেক জনজাতি আছে, যেখানে নরমাংস ভক্ষণের রীতি প্রচলিত। তবে অত্যাধুনিক সমাজে ও সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই রীতি হয়তো অনেকটাই ম্লান, তবু এখনও বেশ কিছু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে গিয়েছে সেই সব প্রাচীন রীতি।

আজকের আলোচনায় এমন এক দেশের কথা বলবো, যেখানে নরমাংস ভক্ষণ বা ক্যানিবলিজম চূড়ান্ত মাত্রায় ছিল। যদিও বর্তমানে সেই দেশ এখন অনেকটাই আধুনিক এবং বিশ্ব বাজারে পর্যটন শিল্পে একটা বড় স্বাক্ষর রাখেছে। ফিজি। সবার আগে দেখে নেওয়া যাক, ফিজি দেশটা কোথায় ?

ভারতের দক্ষিণে রয়েছে, ভারত মহাসাগর, কিন্তু সেখানে ফিজিকে পাওয়া যাবে না, বরং পাওয়া যাবে প্রশান্ত মহাসাগরে। ফলে আমাদের নজর ঘোরাতে হবে ভারতের পূর্বে। অস্ট্রেলিয়ার কাছেই রয়েছে দ্বীপুঞ্জ রাষ্ট্র ফিজি। প্রায় ৩৩০টি দ্বীপ রয়েছে এখানে। ফিজির রাজধানী সুভা। ফিজি যে ধরণের দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র, একে বলা হয় আর্কিপেলগো। একই উদাহরণ দেওয়া যায় জাপানের ক্ষেত্রে।

অনেকেই হয়তো জানেন, মহাসাগরের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্রগুলিতে বেশিরভাগই প্রকৃতিক বিপর্যয় দেখা যায়, যেমন আগ্নেয়গিরি, সুনামি এই ধরণের। এবার দেখা যাক, এই দেশের রাজধানী সুভার কাছে রয়েছে বেকা লেগুন, এখানেই রয়েছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।

ফিজি যেহেতু দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র তাই, অন্য কোনও দেশের সঙ্গে সীমানা অংশীদারিত্ব নেই।

তবে ফিজির সবচেয়ে নিকটতম পড়শি দেশ ভানুতাউ, যা পশ্চিমে অবস্থিত এবং দক্ষিণ পশ্চিমে একটি দেশ রয়েছে নিউ ক্যালেডোনিয়া। তবে নিউ ক্যালেডোনিয়া স্বাধীন কোনও রাষ্ট্র নয়, এটি ফ্রান্সের একটি নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ। এবং আশে পাশে কিছু নিউজিল্যান্ডের কিছু দ্বীপ রয়েছে।

ফিজির প্রধান দুটি দ্বীপ রয়েছে, ভিতি লেভু, বানুয়া লেভু।

৮৭ শতাংশ জনসংখ্যা এই দুটি দ্বীপ ঘিরেই, প্রায় ৯ লক্ষ। বাকি জনসংখ্যা অন্যান্য দ্বীপে। এই দেশে চলে ফিজিয়ান ডলার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফিজিতে রয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ ভারতীয় জনসংখ্যা। ধর্মীয় জনসংখ্যা হারে বিচার করলে, ৬৪.৪ শতাংশ খ্রিস্টান, ২৭.৯ শতাংশ হিন্দু এবং ৭.৭ শতাংশ অন্যান্য।

এখানে ভারতীয় থাকার দরুণ হিন্দি কথারও প্রচলন রয়েছে, তবে ফিজি এবং হিন্দি ভাষা মিশ্রিত হয়ে এক অদ্ভুত ফিজিন্দি ভাষার জন্ম নিয়েছে যা সাধারণ হিন্দি ভাষার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। বর্তমানে যদি বাজার পরিসংখ্যান দেখা যায়, তাহলে বাণিজ্য ও পর্যটনের ক্ষেত্রে ফিজি ভারতীয়দের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য, তার অন্যতম কারণ, বহু বছর ধরেই ভারতীয়দের একটা বড় খুঁটি রয়েছে ফিজিতে। প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ এখানে ভারতীয়।

এবার আসা যাক ফিজিতে ভারতীয়রা কী করে এলো? ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশরা দাসত্ব প্রথা তুলে দেয়। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশরা দাসত্বের বদলে নিয়ে আসে নতুন আইন ডেব্ট বোন্ডেজ। অর্থাৎ ঋণ ঠিকা শ্রমিক।

এটির অর্থ হল, কারও যদি কোনও ঋণ চোকাতে হতে, তাহলে অর্থের বদলে, সে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কায়িক শ্রম দিতে রাজি হত। সেটি ৫ বছর পরে সেটি ১০ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

আর এই কারণে, প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভারতীয় শ্রমিককে নিয়ে যাওয়া হয় । ফিজি ছাড়াও, ত্রিনিদাদ, গুয়েনা, জামাইকা, মরিশাস ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এমনকী ওয়েস্টইন্ডিজের কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভুত দেখা যায়। সেই সময় ফিজিতে প্রায় ৭০ হাজার শ্রিমক পাঠানো হয়।

এবার ইতিহাসের আরও কিছু পিছনের দিকে চলা যাক। ফিজিতে স্থানীয় জন জাতি কত বছর ধরে রয়েছে, তার কোনও হিসেব বা নির্দিষ্ট সময়কাল পাওয়া যায় না। ১৬৪৩ সালে স্থানীয় জনজাতিদের সঙ্গে প্রথম ইউরোপীয়দের সঙ্গে সংযোগ হয়। সেই সময় এক ডাচ নেদারল্যান্ডের নাগরিক) এক্সপ্লোরার এবেল তাসমান প্রথম এই দ্বীপের খোঁজ পান।

পরে স্পেন, ইংল্যান্ড থেকে বেশ কিছু এক্সপ্লোরার এখানে আসেন। কিন্তু এখানে তাঁরা আসার পর, তাঁদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ছিল। কারণ, ইউরোপীয়রা যখন এখানে আসে, তারা জোর করে এই দ্বীপ গুলোকে নিজেদের দখলে নেওয়া চেষ্টা করে।

এখানকার স্থানীয়দের সেটাই ছিল না পসন্দ। ফলে ইউরোপীয়দের তারা চোরাগোপ্তা পথে হামলা চালাত এবং তাদের মেরে খেয়ে ফেলতো। এমন কি লড়াইয়ে জিতলেও ইউরোপীয়দের খেয়ে ফেলতো।

১৮৩০ সালে এখানে আসে পশ্চিমের ক্রিস্টান কমিউনিটি। তারা কাজ শুরু করে, এবং শিক্ষাদান শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে তারা খ্রিস্টান হতে শুরু করে এবং সভ্য হতে শুরু করে। ১৮৭৪ সালে ফিজি ব্রিটিশ ক্রাউন কলোনি হিসেবে পরিচিতি পায়। এর পরের বছর থেকে শুরু হয় নতুন সমস্যা ১৮৭৫-১৮৭৬ পর্যন্ত ফিজিতে মারাত্মক ভাবে থাবা বসায় কলেরা মহামারি।

বহু মানুষের মৃত্যু হয়। প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা কমে যায় এই মহামারিতে। এই সময়ই স্থানীয়রা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে, তাদের বক্তব্য ছিল, এই রোগ পশ্চিমের দেশ থেকে এসেছে। শুরু হয় বিদ্রোহ, যদিও ব্রিটিশরা সেই বিদ্রোহকে আটকে দেয়।

১৮৭৯-১৯১৬ সাল পর্যন্ত এখানে ভারতীয়রা আসতে থাকে ঠিকাশ্রমিক হিসেবে। এখানে মূলত চাষাবাদে তাদের কাজে লাগানো হত। ১৯৬০ থেকে ৭০ সালের মধ্যে এখানে বোন্ডেজ লেবার আইন তুলে দেওয়া হয়, আর সেই সময়ই স্বাধীন রাষ্ট্রের ডাক ওঠে, ১৯৭৯ সালে ফিজি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়।

পেজ ফলো করতে এই ছবিতে ক্লিক করুন

এখানে রাজনীতি বা দেশের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফিজির আদি নাগরিকদের পাশাপাশি স্থানীয় ভারতীয়রাও অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। যদিও গোড়ার দিকে ভারতীয়দের সঙ্গে ফিজির নাগরিকদের দ্বন্দ্ব ছিল। কয়েক বছরের মধ্যে অবশ্য সেই সমস্যা মিটে যায়।

অর্থনীতির দিক থেকে যদি বিচার করা হয়, বর্তমানে ফিজির অর্থনীতি অনেকটাই শক্তিশালী। একটা ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, ভারতের যে সময় কাশ্মীরে ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল, পাক অধিকৃত কাশ্মীরে তেমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই সময় ফিজি পাকিস্তানকে ত্রাণ সরবরাহ করেছিল। সেই সময় ভারতকেও ত্রাণ দিয়েছিল কয়েক হাজার ডলারের।

৭০ সালে দেশ স্বাধীন হল ফিজি। একটা দ্বীপুঞ্জ রাষ্ট্র তাও আবার প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে। অথ্চ এদের অর্থনীতি এতো শক্তিশালী হল কী করে ? ফিজির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান পথ হল সুগার বা চিনি রফতানি।

এ ছাড়া পর্যটনে একটা বড় জায়গা দখল করে আছে। দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র হওয়া প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পশ্চিমী দেশের নাগরিকরাতো বটেই, প্রচ্যের দেশগুলির কাছেও ফিজি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।

ভারতের সঙ্গে ফিজির কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন ? এর একটাই উত্তর যথেষ্ট ভালো। ভারত চায় ফিজিতে যেন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলিতে বাড়তি জায়গা দেয়। ফিজিও চায়, ভারতের সঙ্গে যাতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো হয়।

২০১৭ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় দু দেশের মধ্যে। ভারত ও ফিজি প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়, ফিজির সেনাবাহিনী ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য আসবে।

পাশাপাসি ফিজিতে সামরিক ক্ষেত্রে কোনও সহায়তা চাইলে ভারত সেই সহযোগিতা করবে।এমনকি বিপর্যয় মোকাবিলাতেও সহযোগিতা করবে। ফিজি অস্ট্রেলিয়ার কাছে হলেও, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোটিঙের ক্ষেত্রে দু দেশের সহযোগিতা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

মালদ্বীপ যাওয়ার আগে বানিয়ে নিন প্ল্যান, নয়তো খসতে পারে বাড়তি গ্যাঁটের কড়ি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মালদ্বীপ। এই দেশের অধীনে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপের দেশ। ছোট ছোট প্রায় ১২০০ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!