পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়– বীরভূম। আজ যা পশ্চিমবঙ্গের জেলা, তা একসময় ছিল একটি রাজ্য। আর রাজধানী ছিল রাজনগর। বীর শব্দের অর্থ প্রতাশালী, সাহসী যোদ্ধা। কিন্তু মুণ্ডারী অভিধান মতে, বীর অর্থ জঙ্গল। যদিও লোকিক ইতিহাসকারীদের বিশ্বাস এক ,সময় এখানে প্রতাপশালী বীর রাজারা রাজত্ব করেছেন, সেই থেকেই নাম হয়েছে বীরভূম।
এই সূত্র ধরলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, বীরভূমের বীর রাজা কারা ছিলেন? না এর কোনও সুস্পষ্ট ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। যদিও কিছু প্রচীন বাংলা সাহিত্য, কাব্য, ছড়া থেকে সূত্র মেলে, তার থেকে কিছু আভাস মেলে।
সিউড়ি থেকে উত্তর পশ্চিমে মাইল ছয়েক দূরে রয়েছে বীরসিংহপুর বা বীরপুর গ্রাম। লোকশ্রুতি অনুসারে বীরভূমের রাজারা মুসলিম অভিযানের সময় নগর রাজধানী ছেড়ে এখানে চলে আসেন। এখানেই নাকি প্রাসাদও গড়ে তোলা হয়। কিন্তু বীরসিংহ কে ছিলেন!
দ্বাদশ শতাব্দীতে বাঙালি কবি সন্ধ্যাকরনন্দী রামপালের রচিত রামচরিত কাব্যে মিত্র সামন্তরাজাদের একটা তালিকা মেলে। সেটি হল-
বন্দ্যগুণসিংহবিক্রমশূরশিখরভাস্করপ্রতাপৈস্তৈঃ। স মহাবলৈরুপেতো জেতুং জগতিমলম্ভূষ্ণু।।
প্রাপ্তপ্রবর্ধিতার্জুনবিজয়োহর্থিততবর্ধনঃ সোমমুখশ্চ। অনুগতমাতুলসূনৃপ্রবলভূজালম্ব নো রাম।।
অর্থাত সেই (রামপাল) প্রকাণ্ড বল বা সেনাযুক্ত বন্দ্য (ভীমযশাঃ), গুণ (বীরগুণ), সিংহ (জয়াসিংহ), বিক্রম (বিক্রমরাজ), শূর (লক্ষ্মীশূর ও শূরপাল), শিখর (রুদ্রশিখর), ভাস্কর (ময়গলসীহ-সিংহ) ও প্রতাপ (প্রতাপসীহ-সিংহ) নামে বারশ্রেষ্ঠ সামন্তদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমস্ত জগত জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
ইতিহাসে থেকে যতটুকু জানা যায়, ১৩ শতাব্দীতেই বীরভূম জেলা মুসলিমদের কব্জায় আসে। বীরভূম সীমান্ত প্রদেশ, তাই তারা একটি ঘাঁটি বানিয়েছিল। অনেকে বলেন লখনউর (উত্তরপ্রদেশে লখনউ নয়) বীরভূম সীমান্তের অন্তর্গত মুসলমান শাসকদের প্রধান শাসনকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
মেদিনীপুরের সামন্তরাজাদের বাদ দিলে সেই সময় পশ্চিম সীমান্তে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা ছিলেন বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের হিন্দু রাজারা এবং বীরভূম রাজনগরের মুসলিম রাজারা। তারা যে শুধু শক্তিশালী ছিল তা নয়, তাদের মতো স্বাধীনচেতা সামন্তরারা বাংলার ইতিহাসে খুব কম রয়েছে।
আরও পড়ুন- এই ভূ-ভারতেই রয়েছে আসল সোনার কেল্লা, জানেন কোথায়?
মুঘলযুগে বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের হিন্দুরাজারা ও বীরভূমের রাজনগরের পাঠান রাজারা মাথা নোয়ায়নি। তারা প্রাদেশিক নবাবের কাছে হাজিরাও দেননি। স্বাধীন রাজ্যের প্রতিনিধির মতো তারা নবাব, বাদশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
একাধিক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক দাবি করেছেন, বাংলার নবাব আমলেও, বাঁকুড়ার হিন্দু রাজা ও বীরভূমের মুসলমানরাজারা ছিলেন বাংলার স্বাধীন সামন্ত রাজাদের দুই স্তম্ভ। বাংলার সীমান্তে দুই বীরবিক্রম প্রহরী। বাঁকুড়ার হিন্দু রাজা আর বীরভূমের মুসলমান রাজা এদের মধ্যে কখনও কোনও মারদাঙ্গার ইতিহাস নেই। দুপক্ষ ছিল সমান স্বাধীনচেতা।
আবার বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সময় এই দুই রাজপক্ষ দুর্ভেদ্য ব্যুহ রচনা করেছিলেন, ফলে বর্গিরা ভিন্ন পথে ঢুকতে বাধ্য হয়। এই দুই পক্ষের রাজা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে গিয়ে পথের ভিখারি হয়ে গিয়েছে। আজ রূপকথা মনে হলেও, এটাই বাস্তব এক লুপ্ত ইতিহাস।