পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- বাংলায় নবাবি আমলের পর থেকেই এক শ্রেণির জমিদার, আমির ওমরাহদের উদ্ভব হয়েছিল। তার রেশ এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বাংলা, বিহার, ওডিশা ও অধুনা বাংলাদেশে। এই সমস্ত রাজবাড়ির, জমিদার বাড়ির ইতিহাস কোথাও গর্বের কোথাওবা কলঙ্কের।
হাওড়া জেলাতেও রয়েছে এমন কিছু জমিদারবাড়ি। তাদের মধ্যে অন্যতম আন্দুল রাজবাড়ি। তবে এই রাজবাড়ির কৌলিন্য অন্য সব রাজবাড়ির তুলনায় একদম স্বতন্ত্র এর অন্যতম কারণ ইতিহাস। আর এমন অদ্বিতীয় ইতিহাস হয়তো গোটা বাংলা বিহার ওডিশার অধুনা বাংলাদেশেও বিরল।
আন্দুল রাজবাড়ির বর্তমান পরিবারের তরফে দাবি করা হয়, ১৭৭০ সালে প্রথম আন্দুল রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়। সেই সময় ফিটন গাড়ি চেপে এই আন্দুল রাজবাড়িতে পুজো দিতে এসেছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ। সঙ্গে এনেছিলেন ১০৮ পদ্মফুল। পুজোয় দক্ষিণা দিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। এমন একটা তথ্য, সত্যি আর পাঁচটা রাজবাড়ির ইতিহাস থেকে বেশি চোখ টানে। এমন বাড়িতো অনেক দেখে যায়, কিন্তু স্বয়ং ক্লাইভ এসেছেন, ১০৮ পদ্মফুল নিয়ে। তখনকার দিনে ১০ হাজার টাকা প্রণামী । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর জেনারেলের পদধুলি যে রাজবাড়িতে পড়েছে, তার কৌলিন্যের মর্যাদা একদম উপরের সারিতে থাকবে বলাই বাহুল্য।
আন্দুল রাজবাড়ির প্রথম পুজোকে কেন্দ্র করে আশে পাশে সাত আট গ্রাম উজাড় করে ভিড় জমিয়েছিল এই আন্দুল রাজবাড়িতে। সেই সময় থেকেই পুজো চলছে ধারাবাহিকভাবে। সময় অনেক বয়ে গিয়েছে, গঙ্গার বুক দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। বহু ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে। তার জায়গায় দখল জমিয়েছে কিংবদন্তি। এখন রাজবাড়ির দিকে তাকালে সেই গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের কঙ্কাল হয়তো দেখা যায়। কিন্তু বৈভব, আভিজাত্য নেই বললেই চলে।
এখানে দাবি করা হয়েছে, ১৭৭০ সালে প্রথম আন্দুল রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়। সেই সময় ফিটন গাড়ি চেপে এই আন্দুল রাজবাড়িতে পুজো দিতে এসেছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ। সঙ্গে এনেছিলেন ১০৮ পদ্মফুল। পুজোয় দক্ষিণা দিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। এমন একটা তথ্য, সত্যি আর পাঁচটা রাজবাড়ির ইতিহাস থেকে বেশি চোখ টানে। এমন বাড়িতো অনেক দেখে যায়, কিন্তু স্বয়ং ক্লাইভ এসেছেন, ১০৮ পদ্মফুল নিয়ে। তখনকার দিনে ১০ হাজার টাকা প্রণামী
আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
পুজোকে কেন্দ্র করে আশে পাশে সাত আট গ্রাম উজাড় করে ভিড় জমিয়েছিল এই আন্দুল রাজবাড়িতে। সেই সময় থেকেই পুজো চলছে ধারাবাহিকভাবে। সময় অনেক বয়ে গিয়েছে, গঙ্গার বুক দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। বহু ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে। তার জায়গায় দখল জমিয়েছে কিংবদন্তি। এখন রাজবাড়ির দিকে তাকালে সেই গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের কঙ্কাল হয়তো দেখা যায়। কিন্তু বৈভব, আভিজাত্য নেই বললেই চলে।
এবার একবার চোখ ফেরানো যাক আসল ইতিহাসে, ইতিহাস আর কিংবদন্তি কী ভাবে একে অপরকে আ্ষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে সেটা বুঝে নেওয়া যাক। শুরুটা হয়েছিল, পলাশী যুদ্ধের সময় থেকে। আন্দুল অঞ্চলে চালু ইতিহাস হচ্ছে পলাশীযুদ্ধে সিরাজের হারের পর, তার ধনসম্পত্তি ব্যাপক হারে লুঠ হয়। ক্লাইভের দেওয়ান ছিলেন এই বাড়ির গোড়াপত্তনকারী রামচরণ রায়। তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে তিন বজ্রায় করে ধনসম্পত্তি নিয়ে আসেন এবং আন্দুলে জমিদারি শুরু করেন। সেই সময় মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে রামচরণ রাজা উপাধি পান।
নিত্যনতুন আসল ইতিহাসের তথ্য জানতে আমাদের ফেসবুক পেজ ফলো করুন
এবার দেখে নেওয়া যাক, ১৭৭০ সালে যে সময় এখানে প্রথম পুজো শুরু হয়। সেই সময়, তার কয়েক বছর আগে ও পরে বাংলার বুকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী।
১৭৫৭ সালে ২৩ জুন ঘটেছিল পলাশী যুদ্ধ। অর্থাত যুদ্ধের প্রায় ১৩ বছর বাদে আন্দুল রাজবাড়িতে পুজো শুরু হয়। আর ১৭৬৮ সাল থেকে বাংলার শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর। যা বাংলার ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে কুখ্যাত। তা ভয়ঙ্কর আকার নেয় ১৭৭০ সালে। পরপর তিন বছর বৃষ্টি নেই। অবিভক্ত বাংলার জমি শুকিয়ে কাঠ। অনাহারে লাখে লাখে মানুষ মারা যাচ্ছে। তারই মধ্যে দোসর গুটিবসতন্তের হানা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একের পর শিল্প লাঠে উঠছে। এই সময়ে সারা বাংলা বিহার ওডিশা জুড়ে কোথাও বিশাল বৈভবের সঙ্গে দুর্গাপুজো করা হয়েছে এমন কোনও দলিল, দস্তাবেজ, সরকারি রিপোর্ট ( দশ বিশ বছর আগের বা হালের সংবাদপত্রের রিপোর্ট নয়) কিছুই নেই। তবে শুধু মৌখিক দাবি আছে। বেমানান লাগছে নাকি!
অষ্ঠাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়। বরং সেই সময় অনেক বেশি শক্তিশালী বাংলার নবাব। মুঘল সাম্রাজ্যের গদিতে দ্বিতীয় শাহ আলম থাকলেও, তার ক্ষমতা প্রায় কিছুই ছিল না। তাঁকেই পুরোপুরি নির্ভর করতে হত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর। কোম্পানির সিদ্ধান্তই মানতে হত। ফলে দিল্লির মুঘল বাদশা, আন্দুলের রাজাকে রাজা উপাধি দিয়েছিল, এমন ঐতিহাসিক তথ্য বা সনদের রেকর্ড মেলে না।
সারা বিশ্বের নানা অদ্ভুত কাহিনি জানতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
এবার আসা যাক, আন্দুল রাজবাড়িতে লর্ড ক্লাইভের পুজো দিতে আসার ইতিহাস নিয়ে। লর্ড ক্লাইভ ভারতে আসেন মোট তিনবার। প্রথমবার আসেন ১৭৪৪ সালে এবং লন্ডন চলে যান ১৭৫৩ সালে। দ্বিতীয়বার আসেন ১৭৫৫ সালে আবার চলে যান ১৭৬০ সালে। এই দ্বিতীয়বার ভারতে আসার পরেই পলাশী যুদ্ধে অংশ নেন। তৃতীয়বার সরাসরি জলপথে কলকাতায় আসেন ১৭৬৫ সালে। এবং শেষবারের মতো লন্ডনে চলে যান ১৯৬৭ সালে। ১৭৭৪ সালে ২২ নভেম্বর তিনি মারা যান। অর্থাত ১৭৭০ সালে আন্দুল রাজবাড়িতে তিনি পুজো দিতে এসেছিলেন এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বরং ঐহিতাহিস রেকর্ড বলছে, অবসরের পর তিনি ওই সময় লন্ডনে নিজের বেকারির ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।
একাংশ গবেষকদের মত, বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লার পতনের পরেই, বাংলা জুড়ে একটা ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। তার ঠিক পরেই বাংলায় দেখা দেয় মন্বন্তর। ব্রিটিশ, ততকালীন বাংলার জমিদার, তালুকদার দাপট বাড়তে থাকে। বৃষ্টি নেই, খরা, মহামারীর মাঝেই জোর করে কর আদায় করা হত। জমি বাড়ি, বন্দকের নামে চলত দেদার লুঠ। ১৭৭০ সালের পর এই ক্ষোভে কিছুটা মলম লাগাতেই ব্রিটিশদের পরামর্শে স্থানীয় জমিদারের শুরু করে দুর্গাপুজো। সেই সময় বাংলা যুক্ত ছিল অধুনা বাংলাদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওডিশার একটা বড় অংশ নিয়ে। যদিও এই প্রচীন জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রভাব বেশি দেখা যায়, মূলত কলকাতা ও তার পাশ্ববর্তী জেলাকে ঘিরেই মানে হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমান ও হুগলি। অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী, নাটোর, যশোর, কুমিল্লা, বরিশাল ও চট্টগ্রামের দিকে।
আপনি আমাদের এই ওয়েবসাইটে সাংবাদিকতা করতে চান? মেসেজ করুন আমাদের ফেসবুক পেজে
আন্দুল অঞ্চলেই, খুব কম দূরত্বের মধ্যেই তিনটি জমিদার বাড়ি দেখা যায়। ঘোষেদের সাঁকরাইল জমিদারবাড়ি, কুণ্ডু চৌধুরীদের জমিদার বাড়ি, আন্দুল রাজবাড়ি। দু থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে জমিদার বাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই। কাদের জমিদারির অংশ কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এবং কে কোন সময়কালে জমিদারি পেয়েছে, কাদের থেকে পেয়েছে?
তবে এই সব জমিদারবাড়ি বা রাজবাড়ির স্থাপত্যশৈলী যে অনবদ্য তা অনস্বীকার্য। অবশ্যই হেরিটেজের তালিকায় জায়গা পাওয়া উচিত। কিন্তু প্রশাসনিক উদাসীনতার জেরে ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এই সব জলজ্যান্ত ইতিহাস। সেই জায়গায় ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বহুতল।
বহু ইতিহাস হয়তো হারিয়ে গিয়েছে, জায়গা করে নিয়েছে কিংবদন্তি। সে হোক কিন্তু প্রাচীন এই বাড়িগুলির স্থাপত্য যে এখনও কৌলিন্য বজায় রেখেছে তা হলফ করে বলা যায়। এইসব বাড়িগুলির নিজস্ব এক ঐতিহ্য রয়েছে, সাবেকিয়ানা রয়েছে। হ্যাঁ এ কথা অনস্বীকার্য, এমন বাড়ির দেওয়ালে জড়িয়ে রয়েছে কালো ইতিহাস। সেটাওতো এক ইতিহাসতো। আর আন্দুল রাজবাড়িকে ঘিরে যে ভুতুড়ে বাড়ি বলে প্রচার করা হয়, তা একদমই ঠিক নয়। এখনও এই বাড়িতে মালিকপক্ষ থাকেন। এলাকায় তাঁদের যথেষ্ট সুনাম ও পরিচিতি রয়েছে। এলাকার উন্নয়নমূলক কাজে তাঁদের পাওয়া যায়।
আন্দুল রাজবাড়ি আসতে হলে– হাওড়া স্টেশন থেকে দক্ষিণপূর্ব রেলের লোক ট্রেনে চেপে আন্দুল স্টেশন। টিকিট কাউন্টারের দিকে এসে স্টেশনের বাইরে কিছুটা দূরে টোটো স্ট্যান্ড। টোটো ধরে বলতে হবে আন্দুল রাজবাড়ি ভাড়া ১০ টাকা। এ ছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকে বাস আসছে ৬১ নম্বর রুটের বাস বা আলমপুর মিনিবাস ধরে আন্দুল বাসস্ট্যান্ড। বাঁ হাতের রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটাপথ আন্দুল রাজবাড়ি। আশে পাশে দেখার জায়গা সাংকরাইল জমিদার বাড়ি, মহিয়াড়ী কুণ্ডু চৌধুরী জমিদার বাড়ি। বাকি দুটি বাড়িও টোটো করে যেতে পারেন।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত খবরাখবর, দেশ বিদেশ বেড়ানোর খবরাখবর পেতে আমাদের ওয়েবপেজ ফলো করুন।