সোমনাথ পোরবন্দর দ্বারকা ভুজ
সোমনাথ– দ্বাদশ জ্যাতির্লিঙ্গের অন্যতম সোমনাথের শিবমন্দির। আরব সাগর তীরে সোমনাথ মন্দিরকে নিয়ে নানা কাহিনি রয়েছে। গজনীর সুলতান মাহমুদ মন্দিরের ধনসম্পদের লোভে বহুবার মন্দিরে লুঠ চালান। ১৯৫০ সালে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ঐকান্তিক চেষ্টায় নতুন মন্দির গড়ে ওঠে। সোমনাথকে প্রভাস পাটন নামেও ডাকা হয়।
সোমনাথ মন্দিরসহ আশেপাশের দ্রষ্টব্য দু তিন ঘণ্টায় দেখা হয়ে যাবে। সোমনাথ মন্দির কমিটির উদ্যোগে দিনে তিনবার কন্ডাক্টেড বাস ট্যুর চালানো হয়। প্রতিটি আড়াই ঘণ্টার ট্যুর। মন্দিরের সামনেই রয়েছে এদের বুকিং অফিস। অটোতেও বেড়াতে পারেন। ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা আছে। ভালো করে ঘোরায় এরা। সাগর তীরে আকাশ ছোঁয়া সোমনাথ মন্দিরটি মূল দ্রষ্টব্য। কারুকার্যময় মন্দির। মন্দিরে অত্যন্ত সুন্দর আরতি হয়। রোজ রাত আটটায় মন্দির চত্বরে দেখানো হয় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো।
১৫৫ ফুট উচ্চতার এই মন্দির চালুক্য স্থাপত্যশৈলীতে বানানো হয়েছে। মূল মন্দিরের অদূরে রয়েছে রানি অহল্য বাইয়ের তৈরি আদি সোমনাথ মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহ বেশ কিছুটা নীচে অবস্থিত। এখানেও দেবতা মহাদেব। সোমনাথ থেকে ভেড়াবলের পথে দেখে নিন শশীভূষণ মহাদেব মন্দির। ভেড়াবালে ভাল্কা তীর্থ কৃষ্ণের সমাধিস্থান। এখানে মন্দিরও রয়েছে। সোমনাথ মন্দির থেকে দু কিমি দূরে হীরণ কপিলা ও অন্তঃসলীলা সরস্বতী নদীর মিলন স্থল, ত্রিবেণী সঙ্গম। এখানে নৌকায় জলবিহার করা যায়। নদীর ঘাটকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। কাছে রয়েছে শঙ্করাচার্যের সারদা মঠ ও সূর্যমন্দির।
গোলকধামের অবস্থান হীরণ নদীর তীরে। এখানে রয়েছে গীতা ও বলরাম মন্দির। এখানে শ্রীকৃষ্ণের দেহোত্সর্গ বেদী রয়েছে। সোমনাথ থেকে খুব কম পর্যটকই যান ৩৫ কিমি দূরে চোরবার সৈকতে। সৈকতটি বেশ সুন্দর। যেতে অটো একমাত্র ভরসা। সাদা বালির এই সাগর সৈকত বেশ পরিচ্ছন্ন। ভালো লাগবে সোমনাথের সাগর সৈকতে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য।
আরও পড়ুন- সুরাট বরোদা পাওয়াগড় আমেদাবাদ
কীভাবে যাবেন– আমেদাবাদ থেকে ট্রেন ও বাস আসছে ভেড়াবলে। দূরত্ব ৪৫০ কিমি। সেখান থেকে সড়কপথে সোমনাথ ৭ কিমি দূরে। সোমনাথ থেকে দ্বারকা ২৩০ কিমি। পোরবন্দর ১৩৫ কিমি। দিউ ৯৫ কিমি। মন্দিরের কাছেই রয়েছে সরকারি বাসস্ট্যান্ড।
কোথায় থাকবেন– ভেরাবলে রয়েছে গুজরাট ট্যুরিজিমের তোরণ ট্যুরিস্ট বাংলো। সোমনাথ মন্দিরের আশে পাশে বেসরকারি হোটেল, শিবসাগর, সারদা, শিবম, কৃষ্ণা। থাকার জন্য মন্দির কমিটির গেস্ট হাউসও রয়েছে নানা মানের।
পোরবন্দর–মহাত্মা গান্ধীর জন্মভূমি পোরবন্দর প্রাচীন বন্দরনগরী। আরবসাগর তীরে এই জনপদের সমুদ্র বন্দর দিয়ে এখনও দেশ বিদেশে বাণিজ্য চলে। প্রচীন কালে কৃষ্ণসখা সুদামার নামে এই শহরকে ডাকা হত সুদামাপুরী। শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি অটো নিয়ে দেখে নিতে পারেন। প্রথমের চলুন কীর্তি মন্দিরে। পুরনো শহরের গলিপথে এর অবস্থান। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন মহাত্মা গান্ধী। এখানকার গান্ধী সংগ্রহশালাটি বেশ সমৃদ্ধ। খোলা থাকে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত। গান্ধীজির জন্মস্থান বেশ ভালো ভাবে সাজানো। এই বাড়ির পিছনে গলির মধ্যে রয়েছে গান্ধীজির স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধীর বসতবাড়ি। কীর্তিমন্দিরে বেশ যত্ন নিয়ে মেন্টেইন করা হয়। শহরের মধ্যে রয়েছে সুদামার মন্দির। মন্দিরের গঠন সাদামাটা। তিন কিমি দূরে রয়েছে ভারত মন্দির, আর্যকন্যা গুরুকুল আশ্রম, নেহেরু তারামণ্ডল। এগুলি একই জায়গায় রয়েছে।
ছয় কিমি দূরে হরিমন্দিরের গঠন শৈলি চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এটি খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। লাগোয়া বিশাল লন আর বাগানটি চমত্কার সাজানো। পোরবন্দরের জনপ্রিয় চৌপট্টি সৈকতে দিনভর মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। পরিচ্ছন্ন সৈকত। সাগরতীরের দরবারে কাছে একটি প্রাসাদ রয়েছে, সেটি বাইরে থেকেই দেখতে হবে। চৌপট্টি থেকে দেখা যায় সমুদ্র বন্দরে জাহাজের আনাগোনা। দু তিন ঘণ্টায় পোরবন্দর ভালো করে ঘোরা যাবে।
কীভাবে যাবেন– সোমনাথ থেকে কয়েকটি বাস যাচ্ছে পোরবন্দরে। শহরের কেন্দ্রে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের অবস্থান। স্টেশন এখান থেকে ২ কিমি দূরে। আমেদাবাদ ও হাওড়া থেকে ট্রেন আসে এখানে। হাওড়া থেকে ছেড়ে আসা পোরবন্দর এক্সপ্রেস এখানে আসে। আমেদাবাদ থেকে থেকে ৪০০ কিমি দূরে পোরবন্দর। এপথে বাসও রয়েছে নিয়মিত।
কোথায় থাকবেন- চৌপট্টিতে রয়েছে গুজরাট ট্যুরিজিমের তোরণ ট্যুরিস্ট বাংলো। বেসরকারি হোটেলগুলি রয়েছে এম জি রোড ও তার আশে পাশে ছড়িয়ে। মুন প্যালেস, প্রেসিডেন্ট, শীতল, কুবের, সিলভার প্যালেস ইত্যাদি।
আপনি বেড়াতে ভালোবাসেন তাহলে জুড়ে যান আমাদের ভ্রমণ আড্ডা গ্রুপে
দ্বারকা– সোমনাথের মতো দ্বারকাও আরব সাগরতীরে এক বিখ্যাত তীর্থভূমি। শ্রীকৃষ্ণ এখানে মথুরা থেকে রাজ্যপাট স্থানান্তরিত করেছিলেন। দ্বারকার মূখ্য আকর্ষণ দ্বারকাধিষ মন্দির। এই মন্দির দর্শনের জন্য তীর্থযাত্রীর ভিড় লেগেই থাকে এখানে। গোমতী নদীর তীরে মন্দিরের আবস্থান। ১৭০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দ্বারকাধিষ মন্দিরের ৫টি তলা রয়েছে। পুরো মন্দির জুড়ে কারুকার্যের বাহার। মন্দিরের মধ্যে রয়েছে কালো পাথরের তৈরি রণছোড়জির কৃষ্ণ মূর্তি। মন্দির বন্ধ থাকে সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
মন্দিরের গায়ে রয়েছে শঙ্করাচার্যের প্রতিষ্ঠিত সারদা মঠ। সন্ধেবেলা মন্দিরের বাইরে আলোয় সাজানো হয়। মন্দিরের কাছেই নদীর সঙ্গমস্থল, আরব সাগর ঢেউ ভাঙে সেখানে। সাগরজলে পাথরের আধিক্য বেশি। তাই লাগোয়া সৈকতে স্নানের ভিড় খুব একটা নেই। সৈকতের একপাশে রয়েছে লাইট হাউস। বিকেল চারটে থেকে ছটা পর্যন্ত এর উপরে উঠতে দেওয়া হয়। মন্দিরের আশে পাশে ছড়িয়ে আছে আরও কিছু মন্দির। হেঁটে বা টাঙ্গায় চেপেও দেখতে পারেন অন্যান্য মন্দিরগুলি- ইসকন মন্দির, গীতা মন্দির, স্বামী নারায়ণ মন্দির, সিদ্ধেশ্বর ও ভদ্রকেশ্বর মহাদেব মন্দির।
গায়ত্রী মন্দিরের কাছেই রয়েছে সানসেট পয়েন্ট। সাগরজলে সূর্যাস্তের দৃশ্য চমত্কার লাগে দেখতে। দ্বারকা থেকে দূরের দ্রষ্টব্য দেখতে নগরপালিকা বা প্রাইভেট ট্রেভাল এজেন্সির বাসে চাপুন। সবচেয়ে ভালো ঘোরায় নগরপালিকার কন্ডাক্টেট ট্যুরের বাস। বাস ছাড়ে সকাল ৮টা থেকে বেলা দুটো। এদের ট্যুর বুকিং অফিস রয়েছে সব্জিবাজার ও ভদ্রকালী মন্দিরের কাছে। এরা প্রথমে নিয়ে যায় ১৭ কিমি দূরে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ নাগেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। এখান থেকে ৪ কিমি দূরে গোপী তালাওয়ে কৃষ্ণে গোপীনিরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন ভিল দস্যুদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে। পবিত্র এই জলাশয়ের ধারে রয়েছে কৃষ্ণ মন্দির। জলাশয়ের মাটি তিলক চন্দন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দ্বরকা থেকে ভেট দ্বারকার দূরত্ব ৩০ কিমি। বাস যাবে ওখাতে, সেখান থেকে জলপথে ৫ কিমি দূরে দ্বীপের মাঝে ভেটদ্বারকা ছিল কৃষ্ণের রাজধানী। এখানে মন্দির প্রাসাদ ভূমিকম্পে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফেরার পথে বাস থামবে কৃষ্ণের স্ত্রী দেবী রুক্মিনীর মন্দিরে। এখান থেকে ২ কিমি দূরে দ্বারকা। এখানে দু দিন থাকলে দ্বারকা ভালো করে বেড়ানো যায়।
কীভাবে যাবেন– পোরবন্দর থেকে দ্বারকা ১০০ কিমি। বাস যোগাযোগ রয়েছে। বাসস্ট্যান্ড থেকে মন্দির প্রায় ১ কিমি দূরে। দ্বারকা থেকে আমেদাবাদের দূরত্ব ৫৪১ কিমি। এর মধ্যে বাস ও ট্রেন যোগাযোগ রয়েছে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রেল স্টেশনের দূরত্ব ২ কিমি।
কোথায় থাকবেন– সাগরতীরে রয়েছে গুজরাট পর্যটনের তোরণ ট্যুরিস্ট বাংলো। মন্দির যাওয়ার পথে রয়েছে বেসরকারি হোটেল গঙ্গা, রাজধানী, গুরু প্রেরণা, দর্শন, সুন্দর প্যালেস।
ভূজ- প্রকৃতির বিস্ময় কচ্ছ জেলার প্রধান শহর ভূজ। ২০০১ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে হারিয়ে গিয়েছিল মানচিত্র থেকে ধীরে ধীরে নতুন রূপে আবার সেজে উঠেছে। ১৫৪৮ খ্রিঃ রাজা রাও খেনগারজি ভূজে তার রাজ্যপাট গড়ে তোলেন। দুর্গ, প্রাসাদ মহল্লা নিয়ে প্রচীন ভূজ ছিল বেশ জমজমাট। ওখান থেকে পৌঁছনো যায় কচ্ছের রণ অঞ্চলে। ভূজ শহরের দ্রষ্টব্যগুলি অটো ভাড়া করে দেখে নিতে পারেন।
ভূজের প্রাণকেন্দ্র হামিরসর সরোবর। বিশাল সরোবরের মাঝে সাজানো দ্বীপে রয়েছে রাজেন্দ্র বাগ। হ্রদের কাছে সরোদবাগ প্রাসাদ ও মিউজিয়াম। খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা ও বিকেল ৩টে থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। শুক্রবার বন্ধ।
প্রাগমহল প্রাসাদটি ইন্দো ইউরোপীয় ঘরানায় তৈরি। ১৮৬৫ সালে রাও প্রাগমলজির তৈরি এই বিশাল প্রাসাদ খোলা থাকে রোজ সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা। বিকেল ৩টে থেকে সন্ধে ৬টা। এর পাশেই রয়েছে আয়না মহল। ১৭৫২ সালে তৈরি এটি। এটিও খোলা ও বন্ধের সময় আগের গুলোর মতো। তবে এই প্রাসাদ শনিবার বন্ধ থাকে।
ছত্রি তালাওয়ের গায়ে রয়েছে অজস্র কারুকার্যমণ্ডিত ছত্রি। এগুলো রাজপরিবারের সমাধিবেদী। স্বামী নারায়ণ মন্দিরটিও বেশ পুরনো। দেখে নিন লোকসংস্কৃতি মিউজিয়াম। এবার ভূজ থেকে কিছু দূরে দ্রষ্টব্যের কথা বলা যাক। কচ্ছের রণ বা গ্রাম দেখতে চলুন ৬২ কিমি দূরে হোদকা গ্রামে। ১৪০ কিমি দূরে গ্রেট রণ লাগোয়া ধোলাভিড়া তে দেখে নিন মাটি খুঁড়ে পাওয়া সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন।
২০০ কিমি দূরে দ্রষ্টব্য পবিত্র নারায়ণ সরোবর। ৬০ কিমি দূরে মাণ্ডবীর আকর্ষণ সাগর সৈকত, বিজয় বিলাস প্রাসাদ, হাওয়া মহল, জৈন মন্দির। ভূজ ও মাণ্ডবীর মধ্যে ভালো বাস যোগাযোগ রয়েছে। দিনে দিনে মাণ্ডবী ঘুরে নেওয়া যায়। তবে উল্লেখিত দূরের দ্রষ্টব্যের জন্য গাড়ি করে নেওয়া শ্রেয়। ভূজ নানা হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। শহরের নানা হস্তশিল্পের বহু দোকান রয়েছে।
আরও পড়ুন- ছোট ছুটির খোঁজে ওডিশার অফবিট জায়গা
কীভাবে যাবেন– দ্বরকা থেকে ৪৫০ কিমি দূরে ভূজ থেকে বাস ছাড়ছে। দ্বরকা থেকে জামনগর গিয়ে সেখান থেকে বাস বদলে আবার ভূজে যাওয়া যায়। এই পথের বেশ কিছুটা অংশ গিয়েছে কচ্ছের রণ অঞ্চল দিয়ে। ভূজ থেকে আমেদাবাদ ট্রেন ও বাস যাচ্ছে।
কোথায় থাকবেন– ভূজে বাস স্ট্যান্ডের আশে পাশে রয়েছে বেসরকারি হোটেল, সাহারা প্যালেস, ভি আর পি গেস্ট হাউস, গঙ্গারাম, লোকভিউ, আভা ইন্টারন্যাশনাল।