পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা রঙ্কিনীদেবীর খড়গ গল্পটি কতটি বাস্তব, কতটি অবাস্তব তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু আর পাঁচটা কুলীন দেবীর মতোই এই লৌকিক দেবী যে স্থানীয়দের কাছে এখনও অটল বিশ্বাসের অধিকারী তা বোঝা যায়, ঘাটশিলায় গেলেই। এই লৌকিক দেবীকে ঘিরে রয়েছে নানা লোককথা ও কিংবদন্তী। এই দেবীর আসল গড় ছিল মেদিনীপুরে। কিন্তু তিনি চলে গেলেন ধলভূমগড়ে, কেন? কী সেই কারণ ও ইতিহাস?
তবে সবার আগে জানার চেষ্টা করবো, রঙ্কিনীদেবী আবির্ভাব ঠিক কেমন ভাবে হয়েছিল। এই দেবীর বৈশিষ্ট কি?
শব্দ শুনি নরপতি পশ্চাতে ফিরিলা,
কঙ্কালী দেবীর মূর্তি দেখিতে পাইলা
মহাবেশে মহাকালী মহুলতলায়
বৃক্ষ অন্তরালে অন্তরালে আছে উলঙ্গিনী প্রায়।
দেবী বলে নরপতি, স্মর পূর্ব কথা।
আর না যাইব আমি রহিলাম হেথা।
মহুল বৃক্ষের তলে বিশ্রাম আমার
মহুলিয়া নামে গ্রাম হইবে প্রচার।
আজি হতে নাম মোর হইল রঙ্কিনী।
যাও রাজা এবে তুমি নিজ রাজধানী।
এখানে রাজা অর্থাত ধলভূমের সামন্ত রাজা জগদ্দেউ প্রমার, ঘাটশীলায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আদি দেশ রাজপুতনা থেকে কুলদেবী কংকালীকে এনেছিলেন নতুন রাজ্যে। দেবী বালিকা বেশে রাজার সঙ্গে এসেছিলেন, কিন্তু ধলভূম প্রান্তে আসার পর তিনি আর অগ্রসর হতে চাইলেন না। একটি মহুয়া গাছের তলায় অবস্থান করলেন। রাজা সেখানেই দেবীর পাষাণ মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। দেবীর নাম পরিবর্তন হল, কংকালী থেকে হলেন রঙ্কিনী। আর জায়গার নাম হল মহুলিয়া।
আরও পড়ুন- গাড়োয়াল সফরে যাবেন, দেখুন পুরো প্রতিবেদন
কিন্তু রঙ্কিনী কয়েক শতাব্দী পরেই মহুলিয়া থেকে ঘাটশীলায় মন্দিরে স্থানান্তর হলেন। ঘাটশীলার অন্য নাম রঙ্কিনীভূম। এতো একটি কাহিনি। আরও একটি কাহিনি রয়েছে। আর সেটা মেদিনীপুরে। কাঁসাই নদীর সেতুর কাছে হজরত পীর লোহানির একটি সমাধি রয়েছে। বাংলার অনেক পীরের মতো এখানকার পীর সাহেবও হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিশেষ ভক্তির পাত্র। পীরের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে অনেক রকম কাহিনিও রয়েছে। তার মধ্যে একটি কাহিনি হল এই রঙ্কিনী দেবীকে ঘিরেই।
রঙ্কিনী ছিলেন জঙ্গলমহলের ভয়ঙ্কর বনদেবী, নরবলি ছাড়া তিনি তৃপ্ত হন না। পীর লোহানির সমাধির কাছে একটি জীর্ণ মন্দিরে এক সময় এই দেবী বিরাজ করতেন এবং গ্রামবাসীদের পালাক্রমে নরবলি দিয়ে তাঁকে পুজো করা হত। একদিন এক অসহায় বিধবার পালা পড়ে। তাঁর একমাত্র পুত্রকে নরবলির পাত্র হিসেবে বাছাই করা হয়।
আরও পড়ুন- ছোট ছুটির খোঁজে বেড়িয়ে আসুন ওডিশা
ওই বিধবা পীরসাহেবের কাছে পুত্রের প্রাণভিক্ষা করে। এবং পীর সাহেব রঙ্কিনীদেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে দেবী, মন্দিরের চূড়া ভেঙে পাশের গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যান এবং এক রজকের ঘরে আশ্রয় নেন। এই রজকই নাকি পরবর্তী সময়ে ধলভূম রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে ধলভূমগড়ে রঙ্কিনীদেবী জনপ্রিয় দেবীতো বটেই, তার সঙ্গে তিনি ধলভূম রাজবংশের কুলদেবীও। তাই ধলভূম রাজাদের পুরনো পত্রাদি দেখলে দেখা যায়, চিঠি একদম শুরুতেই লেখা শ্রীশ্রীরামচন্দ্র রঙ্কিনীচরণে শরণম।
আরও একটি কিংবদন্তী রয়েছে এই দেবীকে ঘিরে, দেবী আগে রাক্ষসীর মতো দেখতে ছিলেন এবং পঞ্চকোটের এক দৈত্যের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে তিনি সুবর্ণরেখার তীরে ধলভূমে চলে যান।
এই সমস্ত কিংবদন্তীর প্যাটার্ন যদি ভালো করে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, পীর অথবা দৈত্য দানব যার সঙ্গে লড়াই হোক না কেন, তিনি পরাজিত হয়ে জঙ্গলমহলের মধ্যে সুবর্ণরেখার তীরের দিকে চলে যান। বাইরে বা খুব দূরে কিন্তু যাননি। অর্থাত বনজঙ্গলের অধিবাসীদের প্রিয় লোকদেবী তাঁর অনুরাগী ভক্তদের ছেড়ে যেতে চান না, আর ভক্তরাও ছাড়তে চান না।