গণগনি তার নিজস্ব গৌরবে পরিচিত হোক, গ্রান্ড ক্যানিয়ন অফ বেঙ্গল নামে নয়
অর্বিট ডেস্ক- গোধূলিবেলা, লালমাটি, চেরা রাঙা পথ। রুক্ষ গৈরিক মূর্তি বলিষ্ঠবাহু, প্রকাণ্ড দাপটের সঙ্গে এখনও ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনার্যদের অশ্বত্থামা, গনগনি।
বগড়ী পরগনার মধ্যে শিলাবতী নদীর দক্ষিণ তটে গড়বেতার সংলগ্ন ডাঙাই হল গনগনি। এই অঞ্চলে জঙ্গলশূন্য মাঠের বিশেষত্ব এটাই। এর রূপ নিয়ে আমি বিশেষ কোনও বর্ণনায় যাবো না। তা নিয়ে হয়তো আলাদা একটি প্রবন্ধ রচনা করা যেতে পারে, কারণ অনুভূতি ব্যক্তি বিশেষে আলাদা।
গনগনির মাঠের ঐতিহাসিক স্মৃতি যে গনগনে আগুনের মতো, তা বলাই বাহুল্য। গণবিদ্রোহের কাহিনীর সঙ্গে গনগনির মাঠের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ইংরেজ শাসনকালে এই গনগনির রুক্ষভূমি থেকে যে বিদ্রোহের আগুন তাণ্ডব করেছিল, তা হয়তো অখণ্ড বাংলার আর কোথা থেকেও হয়েছে বলে ইতিহাসবিদেরাও খুঁজে পাননি।
বগড়ীর লায়েক হাঙ্গামা, লায়েক বিদ্রোহ, চুয়াড়বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ ইত্যাদি সব নাম রয়েছে ইতিহাসের পাতা জুড়ে। আসলে পাইক ও লায়েক বিদ্রোহই প্রধান, কিন্তু ইংরেজরা…তা মানতে চায়নি, বরং নোংরা, অসভ্য জাতির কর্মকাণ্ড তুলে ধরতেই, প্রচারে আনা হয়েছিল চুয়াড়বিদ্রোহ। আর এই চুড়ারবিদ্রোহের প্রধান ঘাঁটি ছিল এই গনগনির মাঠ।
বকদ্বীপ বা বক ডিহি থেকে বগড়ী নাম এসেছে বলে বেশ কিছু ইতিহাসবিদের অনুমান। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, বকডিগি-বগ্ডিহি-বাগদি কথার উৎপত্তি , অনুমান করা যায় বাগদিদের নাম হয়েছে এই অঞ্চল থেকেই। বহুকাল আগে, এখানে নাকি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল।
আরও পড়ুন- মাওবাদীদের ডেরা ছুঁয়ে সাহসী সফর প্রমিলা বাহিনির
বাংলার বাগদিদের আদিবাস এখানেই। (তবে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি একাধিক ইতিহাসবিদ)…তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গনগনির কাছেই তেঁতুলি নামে একটি জায়গা রয়েছে, তেঁতুলিয়া বাগদিদের একটি গোত্র। তেঁতুলিয়া গোত্রের বাগদিদের খ্যাতি ও মর্যদা ছিল সবার উপরে।
ইতিহাসবিদ মতিলাল বিশ্বাস তাঁর বকদ্বীপ বইয়েতে লিখেছেন, রাজা গজপতি সিংহের আগে বকদ্বীপে কেউ রাজা ছিলেন না। আদিম জাতিরা সমবেত হয়ে তাদের মধ্যে একজনকে মনোনীত করতো এবং মণ্ডল আখ্যা দিত। যদিও তাঁর সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। বরং তাঁর নেতৃত্বে এলাকার মানুষ জমায়েত হয়ে, যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত, তার পূর্ণাঙ্গ নির্দেশ মণ্ডল দিতেন।
যদিও গজপতি সিং নিজক্ষমতা ও বুদ্ধিবলে স্থানীয় আদিবাসীদের বশীভূত করে রাজ্য চালাতেন। ইতিহাসবিদ মতিলাল বিশ্বাস জনশঅরুতির উপর ভিত্তি করে এই ইতিহাস রচনা করেছেন, যদিও তার প্রামাণ্য তথ্য কিছু নেই।জনশ্রুতি হল, গজপতি সিংহই বগড়ীর আদি প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি জগন্নাথধামে তীর্থযাত্রা করতে এসে রাজ্য প্রতিষ্টার কাহিনী গজপতির সঙ্গেও মিশে আছে। এটি প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগের ঘটনা, ভরতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠারও প্রথম পর্বে।এই গজপতি তার রাজ্যকে দুটি ভাগে ভাগ করেন, একটি গড়বেতা, সেখানে রাজ্যের প্রধান করা হয় ধনপতি সিংহ এবং অন্যটি গোয়ালতোড়ে গণপতি সিংহ।ধনপতির পুত্র হামীর সিংহ, হামীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ।
আরও পড়ুন- কালিম্পং, লাভা লোলেগাঁও সফরের খুটিনাটি
এই রঘুনাথ জঙ্গলমহলের অনেক স্থান বাহুবলে দখল করেন। এবং দক্ষিণে ময়না পর্যন্ত অভিযান করেন। তিনি দুটি মন্দির নির্মাণ করেন। তার মধ্যে একটি গোয়ালতোড়ের সনকা মায়ের মন্দির। (লখীন্দরের মাতা সনকার নামে) আর একটি চন্দ্রকোনার লালজীর মন্দির।রঘুনাথের পুত্র চিত্র সিংহের আমলে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা বগড়ী পরগনা জয় করেন। এবং কয়েক বছর প্রতিনিধি মারফৎ রাজ্য চালানো হয়।
পরে চৌহানসিংহ নামে এক রাজপুত রাজা বগড়ী অধিকার করে, ও পরে বিষ্ণুপুরের অধীনে নিজে রাজ্যশাসন করতে থাকেন। গড়বেতার সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পাশে চৌহানসিংহ বিরাট গড়বেষ্টিত দুর্গ তৈরি করেন। এর পরেও পালাবদল হয় এই অঞ্চলে। বর্তমানে যে রাজবংশ রয়েছে, তাঁরা এসেছিলেন ময়ূরভঞ্জ থেকে। মঙ্গলপোতায় তাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম বাসস্থান তৈরি করেন।