পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– মৃতদেহকে মমি বানানোর কৌশল আবিষ্কার হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগেই। মিশরে রাজা রানিদের মৃতদেহকে মমি বানানোর উদ্দেশ্য যে ছিল ঐশ্বরিক চিন্তা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাচীনকালে কোন প্রযুক্তিতে মমি বানানো হয় তার গুপ্ত কৌশল আজও বিশ্ববাসীর কাছে অধরা। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিতে মৃতদেহকে নানা আঙ্গিকে ও শিল্পসত্ত্বায় পরিণত করার কৌশল সম্ভব।
একটি নিষ্প্রাণ, জড়পদার্থ শরীর। অগ্নিতে দাহ করলে পঞ্চভূতে বিলীন, নয়তো মাটিতে কবরস্থ করলে কয়েক মাসে মাটিতে পরিণত। কিন্তু সেই মৃতদেহকেই যখন এক স্থির চিত্রের মতো অভিব্যক্তি রূপ দিয়ে বছরের পর বছর স্থায়ী করে রাখা হয়! আধুনিক সময়ে তা হয়তো বিশ্ববাসীর কাছে শিল্প কর্ম হলেও, শিল্পীর অস্মিতা প্রকাশ পায় শিল্পকর্মে। যেন সেই ঈশ্বর। মৃতদেহকেও এক চিরন্তন অভিব্যক্তির মধ্যে বেঁধে দিয়েছে কেউ।
গঁথার ভন হাগেন্স। একজন পেশাদার অ্যানাটমিস্ট। মডার্ন মেডিসিনের একজন পেশাদার চিকিত্সক ও অধ্যাপক। অ্যানাটমি ও প্যাথলজিতে পণ্ডিত। হয়তো প্রাচীন মিশরের মমির কৌশল কোনও ভাবে তাঁর মাথায় পোকা নাড়িয়ে দিয়েছিল।
অধ্যাপনার পাশাপাশি চালাতে থাকলেন গবেষণা। মূল প্রশ্নটা ছিল, কী ভাবে একটা মৃতদেহকে দিনের পর দিন সজীব রাখা যায়? শুরু হল খোঁজ, ১৯৭৭ সাল থেকে লাগাতার চেষ্টায় তৈরি করলেন প্লাস্টিনেশন প্রযুক্তি। ১৯৮২ সালে নিলেন পেটেন্ট।
প্রথম দিকে মানব শরীরের একটি অংশকে প্লাস্টিনেশন করা হত। ধীরে ধীরে প্রযুক্তি উন্নত করে গোটা শরীরকে প্লাস্টিনেশনের পথে এগোন এবং সফলতা পান। ১৯৯৫ সালে জাপানে প্রথম একটি সম্পূর্ণ মৃতদেহ প্লাস্টিনেশনের প্রদর্শনী করা হয়। তারপরের দু বছরে ইউরোপ ছাড়াও একাধিক শহরে প্রদর্শনী করা হয়। মোট চারটি দেশে বডি প্লাস্টিনেশনের ল্যাব তৈরি করা হয়। সব মিলিয়ে ৩৪০ জন প্রশিক্ষিত কর্মী কাজ করেন সেখানে।
মৃতদেহ প্লাস্টিনেশনে সফলতা আসার পরেই সেগুলিকে ভাস্করের মতো রূপ দানের চেষ্টা করা হয়। সেখানেও আসে সফলতা। একের পর এক শহরে প্রদর্শনী হয়, এই শিল্পকর্ম দেখে অবাক হয়ে ওঠে দুনিয়া। এক নয়া শিল্পকর্মের দিশা খুলে যায়।
এই কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যেতে গঁথার ভন হাগেন্সকে কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি। একেরপর এক বিতর্কবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছে তাঁকে। মূলত, অর্থোডক্স খ্রিস্টান গোষ্ঠী ও ইহুদী গোষ্ঠী রাব্বিদের তরফে। এতো গেল প্লাস্টিনেশন নিয়ে বিতর্ক। গঁথার ভন হাগেন্স আরও একবার বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ২০০২ সালে।
প্রকাশ্য পাবলিক প্লেসে আইন ভেঙে একবার তিনি অটোপ্সি (মৃতদেহের পোস্টমর্টাম) করেছিলেন। লন্ডন থিয়েটারে ৫০০ জনতার সামনে চলেছিল অটোপ্সি। তাঁকে মেট্রোপলিট্য়ান মেজিস্ট্রেট চিঠি দিলেও পাত্তা দেননি। সেই লাইভ অটোপ্সি দেখানো হয়েছিল একটি টিভি চ্যানেলে। তারপর প্রায় ১৩০টি অভিযোগ জমা পড়ে গঁথার ভন হাগেন্সের বিরুদ্ধে।
প্লাস্টিনেশনের প্রযুক্তি কী?
প্লাস্টিনেশনের ৫টি ধাপ রয়েছে। ১) নির্ধারণ ও শব ব্যবচ্ছেদ।– এই পর্বে, শবটিকে কাটাছেঁড়ার পর, আর্টারির মধ্যে দিয়ে পাম্প করে একটি রাসায়নিক পদার্থ সারা শরীরে পাঠানো হয়। যাতে কোষ ধ্বংসকারী ব্যাকটেরিয়াগুলি বিনষ্ট হয়। এর পর, চামড়া ও মেদ যুক্ত শরীরে আস্তরণকে সরানো হয়। এই প্রথম ধাপের কাজটি করতে ৫০০ থেকে ১০০০ ঘণ্টা লাগতে পারে।
২) শরীরের জলীয় পদার্থ ও মেদ সরানো- প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ হওয়ার পরেই, শরীর থেকে সম্পূর্ণ জল ও মেদ সরিয়ে দেওয়ার পর, শুরু হয় প্লাস্টিনেশনের প্রথম ধাপ। শরীরটিকে পুরোপুরি বরফে মুড়ে দেওয়া হয়, তারপর সমস্ত কোষ থেকে জল বের করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হয়।
৩) শরীরের সমস্ত কোষ থেকে জল ও মেদ নিষ্কাষণের পরেই সারা শরীর জুড়ে প্লাস্টিনেশনের আসল পর্বের কাজ শুরু হয়। সারা শরীরকে লিক্যুইড পলিমার, সিলিকন রাবার, পলিস্টার বা ই পোক্সি রেজিন দিয়ে ভেজানো হয়। তারপর কম তাপমাত্রায় রাসায়নিক পদার্থগুলিকে গরম করা হয় ও ভ্যাকুমের মাধ্যমে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রবেশ করানো হয়। ধীরে ধীরে ভাপের মাধ্যমে রাসায়নিকগুলি শরীরের প্রত্যেকটি কোষের মধ্যে জমাট বাঁধতে থাকে।
৪) প্লাস্টিনেশন শেষ হলে, শরীরের সমস্ত কোষে রাসায়নিক পদার্থ পাঠানো হলে, শরীর তখনও নরম থাকে। এরপরেই শরীরকে একটা শেপে বসানো, শোয়ানো, দাঁড় করানো (যেমন অভিব্যক্তি দেওয়ার প্রয়োজন) হয়। এই সময় তার, ফোমের বাক্স, বড় সূচের সাহায্য নেওয়া হয়। এই বডিকে শেপ দেওয়ার পর্ব চলতে থাকে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত।
৫। চূড়ান্ত ধাপটি হল দেহটিকে শক্তপোক্ত যাতে হয়, তার দিকে নজর দেওয়া। ভালো ভাবে পরীক্ষা নিরিক্ষা চালানো শরীরের কোনও অংশে ফাঁক থেকে যাচ্ছে নাতো? কারণ কোনও একটি কোষে সামান্যতম জল বা মেদ থেকে গেলে, তা দীর্ঘদিন বাদে ফাঙ্গাসের জন্ম দিতে পারে। তার থেকেই ক্ষতি হতে পারে পুরো শিল্পকর্ম। ভালো করে দেখা হয়, প্রকৃতিক আলো, হাওয়া, তাপে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। এই পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে প্রায় এক বছর ধরে।