কর্নাটক– কর্নাটক রাজ্যের পশ্চিমে আরবসাগর। এই রাজ্যের পড়শি রাজ্য হল, গোয়া, কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র। কর্নাটকের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ খ্রি-পূঃ ৩ শতকে চন্দ্রগুপ্তের হাত ধরে মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তন হয় এখানে। এরপর আসে চালুক্য, চোল, গঙ্গা, হোয়েশালা, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজারা। দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে কর্নাটক। সবশেষে আসেন ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজারা। ১৭ শতকে হায়দর আলি ও টিপু সুলতান ক্ষমতা দখল করেন এ রাজ্যের। এর পর ইংরেজদের অধীনে আসে এ রাজ্য।
চন্দন কাঠ, সোনা বাণিজ্যের জন্য বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো এখানে। কর্নাটকের স্থানীয় ভাষা কন্নড়। রাজধানী বেঙ্গালুরু। রাজ্য জুড়ে দেখার বহু দ্রষ্টব্য রয়েছে। তবে পর্যটকরা বেড়ান মহীশূরকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে। তাই এ রাজ্যের মধ্য ও উত্তর অংশের মন্দির নগরী ও অসাধারণ সৈকত রেখা এখনও অধরা বহু পর্যটকের কাছে। এরাজ্যের হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মেরও প্রভাব ছিল। তার নিদর্শন আজও মেলে। কর্নাটকের বিখ্যাত উত্সব মহীশূরের দশেরা।
হাম্পি বাদামি বীজাপুর
তুঙ্গভদ্রার তীরে হাম্পি- তুঙ্গভদ্রার তীরের প্রাচীন জনপদ হাম্পিতে ছড়িয়ে আছে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। ১৪ শতকে হরিহর আর বুক্কা নামে দুই রাজা এই নগরীর গোড়াপত্তন করেন। ১৫৬৫ সালে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে ধ্বংস হয় হাম্পি। প্রায় ২৬ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল, বিজয় নগরের এই রাজধানী শহর। প্রাসাদ, মন্দির, দুর্গ প্রভৃতির ধ্বংসস্তূপ আজও ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে।

সবই পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে। হাম্পির সৌধগুলি ইউনেস্কো ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। হাম্পি বেড়ানোর জন্য অটো বা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। সিজিনে কর্নাটক পর্যটন হসপেট থেকে কন্ডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থা করে। সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে কেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। ট্যুরের বুকিং হয়, বাস ছাড়ে হসপেটের ট্যুরিস্ট অফিস থেকে। হাম্পির বাসস্ট্যান্ডের কাছে রয়েছে বীরুপাক্ষের মন্দির। মন্দিরের দেবতা মহাদেব ও পম্পা দেবী। হাম্পির একমাত্র এই মন্দিরে এখনও পুজো হয়। মন্দিরের গোপূরমটি নটিতলা বিশিষ্ট ও কারুকার্যমণ্ডিত।
মন্দিরের পাশে রয়েছে হেমকূট পর্বত। টিলার উপর ছড়িয়ে রয়েছে কয়েকটি প্রাচীন মন্দির। হাম্পির মাতঙ্গ পর্বতের উপর রয়েছে, মাতঙ্গেশ্বর শিবের মন্দির। হেঁটে উঠতে হবে। ওপর থেকে হাম্পির দৃশ্য অনবদ্য। ১৬ শতকে কৃষ্ণদেবরায় তৈরি করেছিলেন বিঠালা মন্দির। মন্দির মধ্যে পাথরের রথ, রঙ্গমণ্ডপের মিউজিক্যাল পিলার অনবদ্য। এ ছাড়া দেখুন বিঠালা বাজার, অচ্যুতরায় মন্দির, পুষ্করিণী, রানির স্নান ঘর, মহানবমী ডিব্বা।
রয়াল প্যালেস কম্প্লেক্সে হাজার রামমন্দিরের গঠনশৈলী আর পাথরের কারুকাজ অবাক বিস্ময়ে দেখতে হয়। জেনানা মহলে দেখবেন, লোটাস মহল, হাতির আস্তাবল, রানির প্রাসাদ, মিনার। হাম্পিতে প্রবেশের মুখে রয়েছে, বড়াভিলিঙ্গ শিবমন্দির। লক্ষ্মী নরসিংহ মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির, কৃষ্ণবাজার, মাসুভেকালু, গণেশমন্দির, কাডালেকালু গণেশমন্দির, হাম্পিতে তুঙ্গভদ্রানদীর তীরে প্রকৃতিক পরিবেশও বেশ মনোরম।
কীভাবে যাবেন– হাওড়া থেকে অমরাবতী এক্সপ্রেস চেপে নামতে হবে হসপেট। হসপেট থেকে ১৪ কিমি দূরে হাম্পি যেতে দিনভর বাস অটো পাবেন। হসপেট স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড প্রায় দেড় কিমি দূরে। হাম্পিতে বাস থামবে বীরূপাক্ষ মন্দিরের সামনে বাজার লাগোয়া বাসস্ট্যান্ডে। বেঙ্গালুরু থেকে হসপেট ৩৫০ কিমি।
বাদামি– হাম্পি থেকে হসপেট ফিরে সেখান থেকে চলুন বাদামির পথে, বাদামিতে সেকালে ছিল চালুক্য রাজাদের রাজধানী। তখন এই জনপদ পরিচিত ছিল বাতাপি নামে। বাদামির মূল আকর্ষণ এখানকার গুহামন্দিরগুলি। রাজা প্রথম পুলকেশীর পুত্র মঙ্গলেয়া লালপাথরের টিলার গায়ে ৬ শতকের কোনও এক সময় তৈরি করে করেন এখনকার গুহামন্দিরগুলি। বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটেই যাওয়া যায় গুহার দোরগড়ায়। পাহাড় থেকে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে ৪টি গুহামন্দির। মন্দিরগুলির ধরণ অনেকটা মহার্ষ্ট্রের ইলোরার মতো।
এখানে দুটি গুহাই ছিল বিষ্ণুমন্দির। একটিতে শিবমন্দির অন্যটিতে রয়েছে জৈনদের মন্দির। প্রতিটি গুহাই শিল্পমন্ডিত। গুহামন্দির দেখে চলুন পাহাড়ের পাদদেশে অগস্ত্য তীর্থ সরোবরে। জলাশয়ে বোটিং করতে পারেন। হ্রদের একপাশে রয়েছে পুরাতত্ত্ব মিউজিয়াম। এর পাশে রয়েছে আরও একটি টিলা। নীচ থেকে পথ গিয়েছে টিলার উপরে।

এখানে রয়েছে আপার শিবালয় মন্দির, লোয়ার শিবালয় মন্দির। পীরের দরগা, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। হ্রদের ধার দিয়ে খানিকটা এগোলেই রেয়েছে শিবমন্দির। জলের ধারে রয়েছে ভূতনাথ মহাদেব মন্দির। মন্দিরগুলি আকারে ছোট হলেও, গঠনশৈলী ও কারুকার্য খুব সুন্দর। পুরাতত্ত্ব বিভাগ সরোবর লাগোয়া এই অঞ্চলটি ভালো করে সাজিয়েছে।
বাদামি শহরের দ্রষ্টব্য দিনে দিনে দেখা হয়ে যায়। এরপর গন্তব্য বাদামির দূরের দ্রষ্টব্যে। এখানে কোনও কন্ডাক্টেড ট্যুর না থাকায় অটো, গাড়ি ভাড়া করে দূরের দ্রষ্টব্য দেখতে হবে। বাজামি থেকে ৪৪ কিমি দূরে মালপ্রভা নদীর তীরে ছোট গ্রাম আইহোল। পুরো গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র মন্দির। প্রায় ১৩০টি মন্দির। এর মধ্যে গোটা দশের মন্দির সেরা। এখানে দুর্গামন্দিরটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দেখে নিতে পারেন, লাগোয়া সংগ্রাহশালাটিও।

এই মন্দির চত্বরে রয়েছে, লাটকান মন্দির ও জলকুণ্ড, গ্রামের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে হুচিমল্লি মন্দির, রাওলফাডি গুহামন্দির। মীনবস্তি গুহামন্দির। মেগুতি মন্দির, উমামহেশ্বরী মন্দির প্রভৃতি। বাদামি থেকে ২২ কিমি ও আইহোল থেকে ১২ কিমি দূরে পাট্টাডাকালে রয়েছে চালুক্য রাজাদের অমূল্য কীর্তি ১০টি মন্দিরগুচ্ছ।
এখানে মালপ্রভা নদীর তীরে অবস্থিত মন্দিরগুলি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা প্রাপ্ত। মন্দিরগুলির বয়স অতি প্রাচীন হলেও এখনও কারুকার্য অক্ষত রয়েছে। পাট্টাডালও গ্রাম্য এলাকা।
বাদামি থেকে ১৬ কিমি দূরে মহাকূটে রয়েছে শিবমন্দির ও শীতল জলের প্রস্রবণ। মহাকূটেশ্বর মন্দিরের চারপাশ অরণ্যে ঘেরা। এখান থেকে ১১ কিমি দূরে বনশঙ্করী মন্দিরে দেখুন দেবী পার্বতীর আর এক রূপ। মন্দিরের বাইরে রয়েছে পবিত্র সরোবর হরিদাতীর্থ। প্রতিবছর শীতে এখানে বড় মেলা বসে।

কীভাবে যাবেন– হসপেট থেকে ১৭০ কিমি দূরে বাদামি যেতে সরকারি বাস রয়েছে। প্রায় ৪ ঘণ্টার বাস যাত্রা। এছাড়া হসপেট থেকে বীজাপুরগামী বাসে চেপে আড়াই ঘণ্টা বাদে পৌঁছবেন ইলকল। ইলকল থেকে আধ ধণ্টা অন্তর ছাড়ে বাদামির বাস। সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। বাদামি থেকে বেঙ্গালুরু ৪৮০ কিমি। বীজাপুর ১৪০ কিমি। নিয়মিত বাস যায়।
বীজাপুর– কর্নাটকের ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই জেলা শহরের জন্ম হয়, ১০ শতকে চালুক্য রাজাদের আমলে। এরপর দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য রাজা রাজস্ব করলেও বীজাপুরের সমৃদ্ধি ঘটে আদিল শাহী রাজাদের আমলে। সেকালের পুরো শহর নিরাপত্তার কারণে দুর্গ প্রাচীরে ঘেরা। সেসবের চিহ্ন আজও রয়েছে। শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক পুরাকীর্তি। শহরের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘণ্টাপাঁচেকে ভালো করে ঘুরে দেখা যায়। এই ট্যুরের জন্য অটো বা টাঙ্গা ভাড়া করা যায়।
বীজাপুরে মুখ্য দ্রষ্টব্য গোলগম্বুজ। মহম্মদ আদিল শাহের সমাধি সৌধ গোলগম্বুজ এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এর চারপাশে রয়েছে সাতটি তলা বিশিষ্ট, অষ্টকোনাকৃতির চারটি মিনার। প্রবেশের সময় সকাল ৬টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। সৌধের সামনে রয়েছে পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালা। গোলগম্বুজের উপরে রয়েছে হুইশপারিং গ্যালারি। এখানে দাঁড়িয়ে কোনও শব্দ করলে তার আওয়াজ বহুগুন বেড়ে যায়।

গোম্বুজের চূড়াটি আকারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। শহরের কেন্দ্রে দুর্গ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে গগন মহলে। এখানে রয়েছে দরবার হল, আনন্দমহল, সাতমঞ্জিল, মেহেতার হল। এপথেই রয়েছে জামিয়া মসজিদ ও বড়া কামান সৌধ। বাসস্ট্যান্ডের কাছে জোড়গম্বুজ আসলে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি দগরা।
শহর বেড়াতে বেড়াতে একে একে দেখে নিন তাজবাউরি জলাশয়, ৫৫ টন ওজনের মালিক-ই-ময়দান কামান, উপরিবুরুজ তোপ ময়দান, অতীতে বিচারসভা আসরমহল, প্রভৃতি দ্রষ্টব্য।

সবশেষে চলুন বীজাপুরের আর এক আকর্ষণ ইব্রাহিম রোজা দেখতে। সবুজ লনের মাঝে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শিল্পমণ্ডিত দুটি সৌধ এখানের প্রবেশ তোরণটিও আদিল শাহি স্থাপত্য ঘরানার বিশেষ নিদর্শন। এখানে দুটি সৌধই কারুকার্য শোভিত। ইব্রাহিম রোজার গঠনশৈলীতে কতটা তাজমহলের ছাপ চোখে পড়ে।
কীভাবে যাবেন– বাদামি থেকে বীজাপুর ১৪০ কিমি। সরকারি বাস চলে, তবে সংখ্যায় কম। বাসের বদলে যেতে পারেন- বাদামি থেকে বাসে চেপে কেরুর। এপথে অনেক বাস রয়েছে ৩০-৪০ মিনিটে বাস সফর। কেরুর থেকে ১৫ মিনিট অন্তর পাবেন বীজাপুরগামী বাস। সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। বীজাপুরের সরকারি বাসস্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন জায়গার বাস ছাড়ে। এখান থেকে বেঙ্গালুরু ৫৭০ কিমি। বাস যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া বীজাপুর থেকে হায়দরাবাদের বাস রয়েছে নিয়মিত। শহরে অটো চলে।
পরবর্তী পর্বে- মহীশূর, বন্দিপুর, বেলুর, হ্যালোবিদ, শ্রবণবেলগোলা