পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– প্রায় মাস চারেক আগেকার কথা, ফেসবুকে একটা মেয়ের ছবি দেখলাম। মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগলো। স্মৃতিতে কিছুটা আলো ফেলার পরেই মনে করতে কষ্ট হল না। মধুজা দাশগুপ্ত। আমাদের এক সহপাঠী ছিল মধুশ্রীর বোন। দীর্ঘদিন মধুশ্রীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তাই ভাবলাম সে কেমন আছে বা কোথায় আছে খোঁজখবর নিই। এই কথা ভেবেই তার বোন মধুজাকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। এমনকি মেসেজবক্সে কয়েকটা মেসেজও ছাড়লাম।
প্রায় চার দিন কাটল, স্টেটাস আপডেট দেখতে পাচ্ছি অথচ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা ওয়েটিঙেই রয়েছে। অগত্যা আর কথা না বাড়িয়ে আমিও দিব্যি ভুলে গেলাম।
তার ঠিক এক মাস পর, হাওড়া স্টেশনে মধুজার সঙ্গেই দেখা, আমি নিজে গিয়ে কথা বললাম, সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আমি ভুল না করে থাকলে, তুমি মধুশ্রীর বোন না ? মধুজা আমার দিকে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, আমি তাকে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই, বললাম, আমি এবং মধুশ্রী একসঙ্গে পড়তাম, প্রায় বছর ১৫ ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই, পায়েলের কাছে শেষ জেনেছিলাম ও নাকি জার্মানি গিয়েছিল, ব্যস এই টুকুই, তা এখন ও কোথায় আছে ?
মধুজা তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে একটা ঠিকানা লিখে দিল, আর বললো, আমার একটু তাড়া আছে, এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারেন। পুরো আচরণটাই আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল, মধুজা চলে যাওয়ার পরেও হাওড়া স্টেশনে আমি প্রায় ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে ভেবেছিলাম, মানুষের আচার ব্যবহারগুলো কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছে? নাকি এটা এক ধরণের অপমান করা! আবার ভাবলাম, অপমানই যদি হবে তাহলে নিশ্চয়ই ঠিকানা দিত না, সোজা সাপটা আপনাকে চিনি না বলে এড়িয়ে যেতে পারতো।
এই আচরণটা আমার বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল বটে, কিন্তু আচরণের কোনও কারণ বা যুক্তি আমি পাইনি। প্রায় মাস খানেক আগে আমি বেহালার দিকে যাই একটা কাজে। বাসে ভাড়া মেটানোর সময় দশ টাকার নোটের সঙ্গে বেরিয়ে আসে মধুজার দেওয়া কাগজের টুকরোটা। বিষয়টা আবারও প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম, কাগজটা খুলতেই মনে পড়লো, মধুশ্রীর বাড়ির ঠিকানাতো বেহালাতেই, ঠিক করলাম কাজ সেরে একবার দেখা করে নেবো।
সারা দিনের কাজ সেরে, বিকেল পাঁচটা নাগাদ গেলাম মধুশ্রীর বাড়িতে। কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পরেই গেট খুললেন এক ভদ্রমহিলা। আমি চিনি না, মধুশ্রীর মা কিনা, তাও জানি না, কারণ আমি কোনও দিনই তার বাড়িতে আসিনি, এই প্রথমবার। ভদ্রমহিলা দরজা খুলতেই পরিচয় দিলাম, মধুশ্রী কি এখানেই থাকে ? আসলে হাওড়া স্টেশনে মধুজার কাছ থেকে এই ঠিকানা পেয়েছিলাম। এক সঙ্গে কলেজে পড়তাম, বহু দিন যোগাযোগ নেই, তাই ভাবলাম একবার দেখা করি।
ভদ্রমহিলা কোনও উত্তর না দিয়ে দরজাটা অর্ধেক ভেজানো অবস্থায় রেখে ভেতরে চলে গেলেন। আমি পড়লাম উভয়সঙ্কটে, চলে যাবো না দাঁড়াবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার ভদ্র মহিলা এলেন আমাকে ভেতরে যেতে বললেন।
নীচে প্রায় মিনিট খানেক বসার পরেই ভদ্রমহিলা ওপরে যেতে বললেন। আমি দোতলায় গেলাম মহিলার দেকানো রাস্তায়।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই, ডান দিকের ঘর, দরজা খোলাই ছিল, বিছানায় একটা চাদর চাপা দিয়ে মেয়ে শুয়ে রয়েছে, আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটি বললো আয়, ভেতরে আয়, বোস। গলাটা চেনা লাগলেও, মেয়েটিকে প্রায় অচেনা লাগছিল, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড বাদেই আমার ভ্রম কাটলো এতো মধুশ্রী!
তার শরীরে এতো বিভৎস্য রূপ এম ভাবে দেখতে হবে আমি কোনও দিনই ভাবিনি। প্রায় এক বছর সে এ ভাবেই বিছানায় শুয়ে রয়েছে, চোখদুটো যেন গর্তে ঢুকে গিয়েছে, চোয়াল বেরিয়ে পড়েছে, চুল প্রায় অর্ধেকের বেশি পাকা, প্রায় কঙ্কালসার দেহ।
এ তোর শরীরের কী হাল ! বিস্ময়ের সঙ্গে এই প্রশ্ন করতেই আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, জাস্ট জায়গাটা ছেড়ে পালিয়ে যাই, শুধুমাত্র ওর চেহারা দেখেই আমার শরীর অবশ হতে শুরু করছিল।
নিজেকে ধাতস্থ করে কথা বলা শুরু করলাম, অস্বস্তি একটা ছিলই। কিন্তু বছর চারেক আগের তার জীবনে এমন এক অনভিপ্রেত ঘটনা আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরবে, সে নিজেও কল্পনা করতে পারেনি। প্রায় বছর চারেক আগের একটা ঘটনা, সেই একটা রাতের বাস্তববাণ এখনও তাকে তিলে তিলে জর্জরিত করে। রোজ সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, প্রায় চার বছর ধরে। ভারতের সেরা চিকিৎসকদলতো বটেই এমনকি জার্মানিতেও তার চিকিৎসা করানো হয়েছে, কিন্তু নিট ফল শূন্য।
তার জীবন কাহিনির বিয়োগান্ত কথা যখন সে শুরু করলো, তখনই মনে হল এক লহমায় যেন কোনও দুঃস্বপ্নের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলাম। সিলিং ফ্যানের পাখার হুকের গিকে তাকিয়ে সে বলতে লাগল, কর্কটক্রান্তি এক্সপ্রেসের অন্তিম যাত্রার কাহিনি।
মধুশ্রী কথা শুরু করার আগে বাঁ হাত দিয়ে খাটের মশারির ছত্রিতে লটকানো স্যুইচ টিপে বেল বাজালো। ভদ্র মহিলা এলেন, একটা ট্যাবলেট মুখে দিয়ে সামান্য জল ঢেলে দিলেন। মধুশ্রীর মাথা তোলার ক্ষমতাও নেই। হাতগুলো খুব বেশি দূর তুলতে পারে না। এই কলিং বেলটাই তাঁর চাহিদা পূরণের একমাত্র মাধ্যম।
৪ মার্চ ২০১৫। অফিসের কাজের জন্য হায়দরাবাদ যাওয়ার কথা ছিল। হাওড়া হায়দরাবাদ ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেস। ট্রেন সকাল ১১.৪৫ মিনিট। আর সেদিনই তুমুল বৃষ্টি নামল সকাল থেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি, কালবৈশাখী মাখা অকাল বর্ষণ গত ৩০ বছরে এমন হয়েছে কিনা, তা কেউ মনে করতে পারে না। আমি ছিলাম নিরুপায়, যেতেই হবে হায়দরাবাদ। এই পর্যন্ত বলেই কিঞ্চিৎ বিরাম নিল মধুশ্রী।
আবার সে শুরু করলো বলা, ঝড় ঝাপটা বৃষ্টির দাপট এড়িয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছলাম স্টেশনে। শুনলাম, আমার ট্রেন চলবে প্রায় বারোঘণ্টা দেরিতে। উপায় না থাকায় হাওড়া স্টেশনে কোল্করুমে লাগেজ জমা রেখে অপেক্ষায় ছিলাম। সময় কিছুতেই কাটছিল না। অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগছিল, মনে হচ্ছিল বাড়ি ফিরে যাই, এক চূড়ান্ত উভয়সঙ্কটের মধ্যে ছিলাম। একটা সময় ভাবতে ভাবতে ওয়েটিংরুমে বসেই চোখ লেগে গেলে।
কীসের একটা দমকা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১০.১৫ বাজে। মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল প্রায় এক মিনিট লাগল এটা বুঝতে আমি কোথায় আছি। চারপাশ তাকিয়ে দেখি ওয়েটিং রুমে গিজগিজ করছে লোক। আর অপেক্ষা না করে, ক্লোক রুমের থেকে লাগেজ নিয়ে স্টশনে এলাম, বোর্ডে ট্রেনের খবর তখন দিয়ে দিয়েছে। ১৮ নম্বর প্লাটফর্ম।
পৌনে এগারোটা নাগাদ, প্লাটফর্মে ট্রেন এলো। স্টেশনে থিকথিক করছে লোক, বেশ কিছু ট্রেন দেরিতে ছাড়বে, আর কিছু ট্রেন বাতিল হয়েছে। ফলে স্টেশনে তিলধারণের জায়গা নেই। আমার বগি নম্বর ছিল SL-3 ফলে সামনের দিকে দৌড়তে লাগলাম। ট্রেনের গেটে ওঠার মুখে একটা বিদ্যুতের ঝটকা অনুভব করলাম, যেন কেউ সপাটে একটা মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলো। এক লহমায় পড়লাম স্টেশনে।
কে যেন আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে তোলার চেষ্টা করলো, জ্ঞান ফিরলো যখন, তখন দেখলাম এক বৃদ্ধ মানুষ আমাকে তোলার চেষ্টা করছেন, আর আমার চারপাশের আবহ তখন পুরোদস্তুর বদলে গিয়েছে, স্টেশনচত্বর পুরো ফাঁকা, কোনও লোক নেই, চারপাশে শুধু লাল আলোতে ভর্তি, সামনে ট্রেন আছে, কিন্তু লোকের আনাগোনা কিছুই নেই।
ভদ্রলোক আমাকে ধরে তুলে দিলেন আমার কামরায়। আরও একবার টিকিটের সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম বগিটা , ঠিকইতো আছে SL-13। কামরায় ওঠার পরেই বুকটা কেমন হিম হয়ে এলো, একটা লোক নেই, পুরো ট্রেনে আমি একা যাত্রী! পিছন ঘুরে ওই বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করতে যাবো, কিন্তু সেও উধাও, তড়িঘড়ি করে যখন গেটের কাছে এলাম, চারপাশটা কেমন যেন আরও বদলে গেল, বিশাল লম্বা চওড়া স্টেশনটা, যেন একটা ছোট প্রান্তিক স্টেশনে পরিণত হয়েছে, ট্রেন হর্ন দিল, ছাড়তেও শুরু করলো, একটা দমকা ঠান্ডা হাওয়া যেন ধাক্কা দিয়ে গেল। বসে পড়লাম ১৭ নম্বর সিটে।
ফাঁকা ট্রেন, পুরো কামরা জুড়ে নীল আলোর ছটা, আর বাইরের দৃশ্য ঘন অন্ধকারে গ্রাস করেছে, বাইরে শনশনানি বাতাসের দাপট ক্রমেই যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। বেশ ভয় করতে লাগল, পুরো ফাঁকা বগিটা যেন আমাকে গিলে খেতে আসছে, এমন সময়ই কাদের যেন কথা আর হাসিঠাট্টার আওয়াজ পেলাম।
আওয়াজটা অত্যন্ত অস্ফুট, প্রথমে ভেবেছিলাম মনের ভুল, পরে আরও দু তিনবার স্পষ্ট হাসির আওয়াজ পেলাম, মনে জোর পেলাম, ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতেই একটা ঝটকা খেলাম, দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো তিন্নি। তিন্নি, ভালো নাম তন্নিষ্ঠা, বয়স ৬। আমার কাকার মেয়ে। এই ট্রেনে তিন্নিকে দেখে অবাকই হলাম।
তুই এখানে কী করছিস? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাকে। তিন্নি বললো, আমরা হায়দরাবাদ বেড়াতে যাচ্ছি এসো মা বাবাও আছে। আমার হাত ধরে নিয়ে গেল, ৪২, ৪৩, ৪৪ নম্বর সিট ওদের, কাকা কাকিমা আমাকে দেখেই বললো, আয় বোস এখানে।
আমি পুরোপুরি হতবাক, অনেক প্রশ্ন! আজ সকাল পর্যন্ত জানতাম না, কাকু কাকিমারা একই ট্রেনের যাত্রী। কথা শুরু করবো কি, তিন্নি ফাঁকা ট্রেনে দৌড়তে লাগল। আমি আটকাতে গেলাম তার হাত ধরে, তিন্নির বাঁ হাতটা আমার হাতে খুলে চলে এলো।
তিন্নির ডান হাতটা আমার ডান হাতের মুঠোয়, আর তিন্নিতে দেখলাম, একটা হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, দৌড়তে ধরতে যাব কি, ট্রেনের দুরন্ত গতিতে একটা ঝাঁকুনি, ব্যাস, চোখের সামনে অন্ধকারে শুধু তার একটা চিৎকার ক্রমেই ক্ষীণ স্বরে রয়ে গেল, মুন্নাদি….। তখনও পর্যন্ত আমার ডানহাতে ধরা তিন্নির কাঁধ থেকে খুলে যাওয়া ডান হাতটা।
জানি না, কতক্ষণ আমি ট্রেনের বাথরুমের পাশে মাটিতে বসেছিলাম। কিছু চিৎকারে হুঁশ ফিরলো, লোকের কথাবার্তা চলছে।
মনে পড়লো তিন্নির কথা, নিজের ডান হাতটা ভালো করে দেখলাম, আশে পাশেও দেখলাম, না কোথাও কোনও হাত নেই, ৪২,৪৩,৪৪ নম্বর সিটে গিয়ে দেখি কাকু কাকিমাও নেই, এবার আওয়াজটা কেমন বাড়ছে, আমি দৌড়ে গেলাম ১৭ নম্বর সিটে, কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আশে পাশের সিটে দখল জমিয়েছে। প্রত্যেকেই যে অসুস্থ , প্রচণ্ড অসুস্থ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, রুগ্ন শরীর, কঙ্কালসার দেহ, কয়েকজন অনবরত কাশছে আর তাদের বাড়ির লোক বুকে হাত বোলাচ্ছে।
আমি জানি না, কখন, কোথায় কোন স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল, কাকু কাকিমা নেমে গিয়েছে কিনা তিন্নির জন্য, এই লোকগুলোই বা কোথা থেকে উঠেছে কিছুই জানি না।…তবে নিজেকে যেন মনে হচ্ছিল আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। আশে পাশে মানুষের মুখ দেখতে পাচ্ছি নীল আলোর আভায়, কিন্তু এক সেকেন্ডও তাদের মুখ যেন মনে রাখতে পারছি না। নিজের সিটে এসে বসলাম। ক্লান্ত লাগছে। প্রচণ্ড ক্লান্ত। চোখের পাতা ভারে নেমে এলো।
একটা ঝাঁকুনিতে চোখ খুললাম, ট্রেনটা যেন সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। বাইরের জানালা দিয়ে চোখ ফেরাতেই দেখি, একটা ছোট্ট স্টেশন, গাছগাছালিতে ভর্তি,কিন্তু কী স্টেশন সেটা বোঝার উপায় নেই। স্টেশনে কোনও লোক নেই, ট্রেনের ভিতরেও চারপাশ তাকিয়ে দেখি সেখানেও কোনও মানুষজন নেই। আমি আবার অবাক হয়েই, গেটের দিকে গিয়ে দু দিক ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।
প্রায় ৫০ ফুট দূর হবে একটা ছোট্ট ঘর বা কেবিন মতো রয়েছে। সিগন্যাল দেখলাম লাল হয়ে রয়েছে, ট্রেন থেকে নেমে দ্রুত গতিতে হেঁটে গেলাম কেবিনে, তিনটে লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলছে একটা অপরিচিত ভাষায়। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম এই স্টেশনের নাম কি ?
তিনটো লোকই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। একজন জিজ্ঞেস করলেন হিন্দিতে, আপ কোনসা ট্রেনমে আয়ি হ্যায় ?
বললাম, ইস্ট কোস্ট।
এবার তিনজনে তারস্বরে অট্টহাসিতে মেতে উঠল, আমার বুকটা কাঁপতে শুরু করলো। একজন হাসি কিছুটা থামিয়ে বললেন, আপকা বগি নম্বর ক্যায়া হ্যায় ? আমি বললাম SL-13 ।
ভদ্রলোক এবার আমাকে বললেন, ইস তরফ দেখকর বোলিয়ে ট্রেন মে কিতনা বগি হ্যায়?
আমি ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ইঞ্জিন রয়েছে, তার সঙ্গে লাগানো রয়েছে মাত্র তিনটি বগি। আমি দৌড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসি, সঙ্গে কেমন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমি যে বগিতে ছিলাম, সেটা কোথায় ?
উল্টো দিক থেকে একটা আওয়াজ আসে, দিদি এদিকে এটা আপনার ট্রেন। আমি পিছন ফিরতেই দেখি একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে, অথচ আমি যখন নেমেছিলাম তখন ওদিকে ট্রেনও ছিল না, ট্রেন লাইনও ছিল না। একবার এ দিক আর ও দিক দেখতে গিয়ে ট্রেন হর্ন দিল। আমি যেন একটা প্রকাণ্ড আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কোনটা আমার ট্রেন সেটা বুঝতেই পারছিলাম না। আর আমার কামরা কোথায় গেল সেটাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, বলে উঠলাম হেল্প হেল্প….
সন্ধে সাতটা। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কলকাতার পিচের রাস্তা ধুয়ে দিয়েছে ক্ষণিকের বৃষ্টি। শহুরের রাস্তায় নিয়নের আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির কারণেই হয়তো শহুরের যানবাহনের গতি কিছুটা কম, বাস, ট্যক্সির হর্ন, কন্ডাক্টদের চিৎকারের কোলাহল যেন একটু বেশি কানে বিঁধছে। বেহালা চৌরাস্তা থেকে বাস ধরলাম। মধুশ্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়েছি প্রায় ১৫ মিনিট হল, তবু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে আছি। প্রায় তিন ঘণ্টা ওই ঘরটায় বসে থেকে, নিজেকে দমবন্ধ করা পরিবেশের বন্দি মনে হচ্ছিল।
হাওড়ার বাসে বসার জায়গা পেলাম, জানালার বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস যেন শীতের আবহ তৈরি করছিল। একটা ঘটনাকি মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে! জীবনের একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা শুরু করে কি, তার মোড় এমন ভাবেই ঘুরে যেতে পারে? হয়তো পারে, কারণ প্রবাদেই রয়েছে, সত্যিটা কল্পনার থেকেও যে বিচিত্র!
বাসটা যখন আকাশবাণীর পাশ দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছে, তখনও আমি জানতাম না পর মুহূর্তে ঠিক কী হবে! আমরা কেউই জানি না। বাবুঘাটের কাছে সিগন্যালে বাসটি যখন দাঁড়ালো, আমি নেমে পড়লাম। আসলে বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফেরার ইচ্ছেটাই যেন উধাও হয়ে গেল। চাঁদপাল ঘাটে গিয়ে জেটির মধ্যে বসলাম। আলো আঁধারি পরিবেশে দুদিক যেন রহস্যময় আর তার মাঝে বহু রহস্যের উত্তর নিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী, বহু মৃত্যুর অন্তিম সঙ্গিনী। কলকাতা থেকে হায়দরাবাদ যাওয়ার দিনটাই মধুশ্রীর জীবনে ছিল এক অদ্ভুত টার্নিং পয়েন্ট। হাওড়া স্টেশনে ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রের অপেক্ষায়তো সে ছিল, ট্রেনেও উঠেছিল, কিন্তু এক লহমায় তাঁকে গ্রাস করে অবচেতন। না সেই মুহূর্তের পর তার আর হায়দরাবাদ যাওয়া হয়নি, বরং তার জায়গা হয়েছিল প্রথমে অর্থোপেডিক হাসপাতাল পরে একটি কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে। একটা ব্ল্যাক আউটই তাঁর গন্তব্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
এক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ইস্ট কোস্টের বদলে হয়ে উঠল কর্কটক্রান্তির যাত্রী। SL3 বগি হয়ে উঠল SL 13। দুর্ভাগ্যের প্রতীক। আসলে তাঁর জীবনে ভিলেন হয়ে উঠেছিল তাঁরই শরীরে একটা অংশ। অতিরিক্ত বাড়তি মাংসপিন্ড। টিউমার। ব্রেন টিউমার। অপারেশনের পরেই সে শয্যাশায়ী হয়ে যায়। সুস্থ হওয়াতো দূর অস্ত্। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রবল মাথা যন্ত্রণা নিয়ে সে ভুল বকতে থাকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, করানো হয় সিটি স্ক্যান। ধরে পড়ে ব্রেন ক্যানসার। অপারেশন সম্ভব নয়। ওষুধই ভরসা।
এখন প্রায়ই একটা ট্রেনে চড়ে পড়ে মধুশ্রী। একটাই ট্রেন, কর্কটক্রান্তি এক্সপ্রেস। সেখানে কখনও যাত্রী থাকে, কখনও থাকে না। কখনও সেখানে দেখা পায় চেনা চরিত্রদের কখনওবা অচেনা। আসলে চেনা চরিত্রগুলোও যে কালের নিয়মে হারিয়ে যাওয়া। ওই যে তিন্নি আর তার বাবা মা, ওরাওতো হারিয়ে গেছে। ২০১০ সালে জ্ঞানেশ্বরী অ্যক্সিডেন্টে।
মধুশ্রী কখন চেতন মনে থাকে, কখন অবচেতনে কেউ জানে না, ও নিজেও জানে না। কখন এক অজানা কুহেলি এসে ওর নিউরোনপুঞ্জকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, তার হিসেব কেইবা রাখে, রাখতে পারে। ঘরের মধ্যেই এমন ট্রেনে প্রায়ই উঠে পড়ে মধুশ্রী। চলে এক অজানা গন্তব্যে, কিন্তু মাঝপথেই ফিরে আসে বাস্তবে, অসম্পূর্ণ থাকে তার যাত্রা। চিকিৎসক তাঁকে একটা ওষুধ দিয়েছে, নাম মরফিন। যাতে সে ঘুমোয়, শান্ত থাকে, যন্ত্রণায় ছটফট না করে।
কিন্তু ঘুমের ঘোরে যখন সে নিজেকে স্টেশনে পায় এবং প্লাটফর্মে কর্কটক্রান্তি এসে দাঁড়ায়, তখন তাকে ১৩ নম্বর বগিতে উঠতেই হয়, না চাইলেও উঠতে হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় মানসিক এই স্থিতির নাম ডিলিরিয়াম। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের অন্তিম পর্যায়ে থাকার একটি সঙ্কেত।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ইবসেনের একটি নাটক পড়েছিলাম ঘোস্ট। অশরীরি। সেই নাট্যাংশে কোথাও ভূত ছিল না, কিন্তু পরম্পরায় এক বাহিত রোগকেই ইবসেন ভূত বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আমাদের সমাজে কর্কটও সেই জায়গা নিচ্ছে, জিনের মধ্যে পাকাপাকি জায়গা করে নিচ্ছে, নামও কুড়িয়েছে অঙ্কোজিন।
এখন প্রশ্ন এই ভৌতিক রোগ থেকে মুক্তি কি আছে ? কার জীবনে কর্কটক্রান্তি এক্সপ্রেস কত নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে কেউ জানে না। গঙ্গাকি জানে ? হয়তো।