স্বাতী চট্টোপাধ্যায়:- পেশার স্বার্থে ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘোরার সুযোগ হয়েছে। প্রত্যেকবারেই বিভিন্ন জায়গার আমি ইতিহাসকে, তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে খুঁটে খুঁটে দেখার, ও উপলব্ধী করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু গত বছর বর্ষার ঠিক মাঝামাঝি সময়ে আমার মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণটা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হয়ে রইল।
হাড় হিম করা সেই অভিজ্ঞতা আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।১ জানুয়ারি ২০১৬। স্থান যাদবপুরের মিতাদির বাড়ি। ফেসবুকে পরিচয়। পরিবারসমেত ঘুরতে ভালো বাসেন। ওনার একটা বড় ভ্রমণর দল আছে। প্রায় ৩০ জনের। গেলাম আড্ডা দিতে। চা পকোড়া খেতে খেতে…শুরু হল আলোচনা…আমি বললাম, এবারে অশ্বত্থামাগিরি পরিদর্শনে গেলে কেমন হয়?এই কথাটা শুনেই মিতাদি ও আরও সদস্যরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। মিতাদি বলেই ফেললেন, সেটা কোথায়? বললাম মধ্যপ্রদেশ। ও দিক থেকে সুচরিতাদি প্রায় লাফিয়ে বলে উঠলেন…মধ্যপ্রদেশ আমার চারবার ঘোরা…পুরো ম্যাপ নখদর্পণে…অশ্বত্থামাগিরি যদি কোনও ভালো ঘোরার জায়গা হত তাহলে নিশ্চয়ই জানতাম। ওই ছোটখাটো টিলা মিলায় ঘুরে লাভ নেই।
আমি বললাম অসিরগড় কেল্লা? নাম শুনেছো? সুচরিতাদির উত্তর, শুনেছি, যাইনি। আমি বললাম, যাওয়াই যাক না। বিস্তর তর্ক বিতর্কের পর ঠিক হল আমাদের অভিযান অশ্বত্থামাগিরি। অধুনা অসিরগড় কেল্লার।অশ্বত্থামাগিরি। মহাকবি ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে উল্লিখিত অশ্বত্থামাগিরি। মহাভারতের সূত্র মতে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কৌরবদের পক্ষে তিনজন বেঁচেছিলেন, কৃপাচার্য, কৃতবর্মা এবং অশ্বত্থামা। অভিমূন্যপুত্র পরীক্ষিতকে, উত্তরার গর্ভে থাকাকালীন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে নিহত করেছিলেন অশ্বত্থামা। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণবাসুদেব প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে অভিশাপ দেন।
এখানে অনেকেই হয়তো জানেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা স্বয়ং মহাদেবের কাছে বর পেয়েছিলেন তিনি অমর। তাঁর মৃত্যু কখনও হবে না…কোনও মানব বা ভগবানও তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। সেই সূত্র ধরেই শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে অমরত্ব ছিনিয়ে নিতে পারেননি। কিন্তু অভিশাপ দিয়েছিলেন, তাঁর সারা শরীর জরাগ্রস্ত হবে। এই ভূখণ্ডে তাঁকে জীবন্ত অবস্থা প্রেতাত্মার মতো ঘুরে বেড়াতে হবে। যন্ত্রণায়, কষ্টে মৃত্যুর কামনা করবে কিন্তু তা পাবে না।
এমনকী তাঁর মাথায় থাকা জন্মগত মণিও নিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কারণ এই মণিই ছিল অশ্বত্থামার একমাত্র অস্ত্র যার মাধ্যমে তিনি যে কোনও ক্ষত থেকে মুক্ত হতে পারতেন। কথিত আছে, এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেই ফের মহাদেবের তপস্যা করতে এই গিরিতেই তিনি বসবাস শুরু করেন। তাই এই পাহাড়ের নাম অশ্বত্থামাগিরি।চারপাশ ঘন বন জঙ্গল আর তার মাঝে নর্মদা ও তাপ্তী নদীর স্রোত। এই গিরি অঞ্চলেই ছিল মহাকবি ব্যসদেবের তপোভূমিও।
১ জুলাই ২০১৬। সকাল থেকেই মেঘের মুখ ভার। হাল্কা বৃষ্টিও পড়ছে। সকাল ১০টা একটি ট্রাভেলার নিয়ে, বুরহানপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ জন সদস্য বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য, অশ্বত্থামাগিরি অধুনা অসিরগড় কেল্লা। সঙ্গে গাইড কাম ড্রাইভার হরি সিং।
মধ্যবয়স্ক এই গাড়িচালকের এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও যেমন, তেমন অমায়িক ব্যবহার।প্রায় তিরিশ কিলোমিটার রাস্তা। ঘণ্টা খানেকের পথ। লালবাগ রোড ধরে কিছুটা চলার পর, বাঁ দিকে দরগা ই হাকিমি রোড পার করে খাড়গং-বুরহানপুর রোড ধরল আমাদের গাড়ি। সোজা পথ।
প্রায় ১২ কিলোমিটার যাওয়ার পর ডান দিকে বাঁক নিল গাড়ি, আশা দেবী রোড। এই পথে কিছুটা যেতেই দূর থেকে চোখে পড়বে অসিরগড় কেল্লা বা অশ্বত্থামাগিরি। এই পথ চলার পথেই, সহযাত্রীদের সঙ্গে একটু ইতিহাসটাও আওড়ে নিচ্ছিলাম। ওই অঞ্চলের সমতল থেকে এই কেল্লাটি ২৫৯.১ মিটার উঁচুতে।
আর সমুদ্রতল থেকে হিসেব করলে উচ্চতা ৭০১ মিটার। পাহাড় ও বনাঞ্চলে ঘেরা সতপুরা রেঞ্জের এটি সবচেয়ে উঁচু এলাকা।নিরাপত্তার স্বার্থে এই দুর্গম জায়গাতেই দশম থেকে তেরো শতাব্দী পর্যন্ত নিজের এলাকায় রাজ করতেন হিন্দু টাক রাজারা ।
অনুমান সেই সময়ই কেল্লার নির্মাণ। ১২৯৫ সালে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি এই কেল্লা প্রথম জয় করেন। পরে তা দখলে আসে হিন্দু রাজা আহিরের। ১৩৯৯ সাল পর্যন্ত এই কেল্লা রাজা অহিরের দখলেই ছিল। ইতিহাস বলছে, দিল্লির ফারুকি সাম্রাজ্যের পত্তনকারী নাসির খান, অহিরের কাছে আবেদন করেন, এই কেল্লাতে তাদের পরিবারকে জায়গা দেওয়া হোক। বিশেষ করে মহিলা সদস্যদের।
কারণ বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। আর এই কেল্লার মতো নিরাপদ জায়গা তার কাছে নেই।নাসিরের আবেদন মেনে তাদের জায়গা দেওয়া হলে, শুরু হয় বিশ্বাসঘাতকতা। কেল্লাচ্যুত করা হয় অহিরকে। ১৫৩৬ সেই সময় রাজত্ব করছিলেন আদিল শাহ। তিনি রাজা আলি খান নামেও পরিচিত ছিলেন।
এই সময়ই গুজরাট দখলের পর বুরহানপুরে হামলা চালায় হুমায়ুন। আদিলকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাঁর শরণাপন্ন হতে এবং শাহ উপাধি ত্যাগ করতে। আদিল, হুমায়ুনের নির্দেশ অমান্য করে। ফল, হুমায়ুনের বিপুল সেনাবাহিনী জয় ছিনিয়ে নেয় কেল্লার।আদিল হার স্বীকার করে হুমায়ুনের বশ্যতা স্বীকার করে।
পরে আকবরের আমলে, আদিলের পুত্র বাহাদুর খান, মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতে না চেয়ে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে। এবং জানিয়ে দেন, তিনি আকবরকে কোনও কর দেবেন না। অগত্যা হামলা চালালেন আকবর, কেল্লা ফতে করে নিজের দখলে রাখেন ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
এই আকবরের সময়কালেই উত্তরভারত ও দক্ষিণভারতকে জুড়তে এই বুরহানপুরকেই প্রধান সংযোগকারী প্রধান দরজা হিসেবে পরিচিতি দেন আকবর। খুলে যায় উত্তর ও দক্ষিণের নয়া দিগন্ত। এর পরে জাহাঙ্গিরের আমলে এই কেল্লা মুঘলদের হাত ছাড়া হয়। কখনও যায় হোলকারদের হাতে, কখনওবা পেশোয়ারদের পরে শাজাহান ফের দখলে নেন কেল্লা।
১৬৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দে শাজাহানকে বন্দি বানান তারই পুত্র ঔরঙ্গজেব। সেই সময় এই কেল্লার প্রধান করা হয় আহমেদ নাজেম সাইকে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই কেল্লা পুরোপুরি ব্রিটিশদের হাতে যায়।কেল্লার নির্মাণশৈলী দেখলে বোঝা যায়, হিন্দু স্থাপত্যের সঙ্গে মুঘল ও ব্রিটিশ স্থাপত্য সংযোজন হয়েছে।এই ইতিহাসের স্মৃতিচারণের সময় যখন শেষ আমরাও কেল্লার পাহাড়ির পাকদণ্ডি রাস্তা পার করে মূল ফটকের সামনে হাজির।
গাড়ি থেকে নামতেই, চোখের সামনে ভেসে উঠল অপূর্ব দিগন্ত, মেঘের কোল ঘন কাজলে ভরা, হাল্কা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে আর সিক্ত হচ্ছে অসিরগড় কেল্লার প্রাচীন ইতিহাস।সেই সঙ্গে মনটাও যেন কেমন হুহু করে উঠছে।
কারণ আসার পথেই গাড়ির চালকের কাছে শুনলাম এই কেল্লার এক করুণ কাহিনি। যা অলিখিত, শুধু বেঁচে আছে, শ্রুতিতে। সেই সঙ্গে রয়েছে কেল্লার আনাচে কানাচে জমে থাকা এক অভিশপ্ত ইতিহাস আর কিংবদন্তি। ইতিহাসতো অনেক পড়েছি, কিন্তু অভিশপ্ত ইতিহাস! তার রহস্যতো উন্মোচন করতেই হবে।…………..
এই খবরের আপডেট পেতে আজই আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান