পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– পরশুরাম। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতারকে ঘিরে রয়েছে, নানা লোক কাহিনি, কিংবদন্তী। সুব্রাহ্মণ, বীর, যোদ্ধ, পিতার আদেশপালক। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বর্ণময় খ্যাতি উল্লেখ রয়েছে রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও।
ভারতের প্রাচীন পৌরাণিক গাথার মতে, সাত চিরঞ্জীবীর কথা উল্লেখ রয়েছে। অর্থাত তারা অমর, মৃত্যু নেই। জীবিত আছেন, এ ব্রহ্মাণ্ডের বিনাশের আগে পর্যন্ত তারা জীবিত থাকবেন। সেই সাতজনের মধ্যে পরশুরাম অন্যতম। তাঁকে ঘিরে যে জনপ্রিয় কিংদন্তী রয়েছে, তা হল, পরশুরাম ছিলেন ঋষি জমদগ্নি ও রেনুকার পুত্র। রেনুকা একবার নদীতে স্নান করতে যান, সেখানে তিনি এক রাজার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি জানার পর জমদগ্নি ক্ষুব্ধ হন এবং পরশুরামকে মাতৃহত্যার নির্দেশ দেন।
পরশুরাম কোনও কারণ জিজ্ঞাসা না করেই, পিতার আদেশ মান্য করেন। মাকে কুঠার দিয়ে শিরোচ্ছেদ করেন। পরে জমদগ্নি যোগবলে ফের রেণুকাকে পুনর্জীবিত করেন। কিন্তু মাতৃহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ তাঁর কর্মে যুক্ত হয়। কুঠারে লাগে থাকা রক্ত ধুতে নদীতে গেলে, সেই দাগ হাত বা কুঠার থেকে যায় না। ফলে এক ঋষির পরামর্শে তুঙ্গ নদীতে গিয়ে তিনি পবিত্র জলে কুঠার ও হাত ধুয়ে পরিব্ত হন।
আরও একটি কাহিনি হল, দেবকুলের গোমাতা কামধেনুর কন্যা সুরভী (গরু) ছিল জমদগ্নির আশ্রমে। রাজা কীর্তবির্জার্জুন জমদগ্নির আশ্রমে এসে সুরভী দেখে পছন্দ হয়, প্রায় জোর করে নিয়ে যায়। বিষয়টি জানার পরেই পরশুরাম রাজাকে ধরে তার হাত কাটে পরে মুন্ডচ্ছেদ করে সুরভীকে নিয়ে আসে। বিষয়টি জানার পরেই জমদগ্নি পরশুরামকে জানান, তিনি রাজাকে হত্যা করে গর্হিত অপরাধ করেছেন। তিনি ব্রাহ্মণ সন্তান, যতক্ষণ না কাউকে পুনর্জীবিত করার ক্ষমতা লাভ করছো, ততক্ষণ কাউকে হত্যা করতে পার না। তুমি রাজাকে বোঝাতে পারতে, রাজা যে অপরাধ করেছে, তার প্রয়শ্চিত্ত করুক। তুমি সেই সুযোগ দাওনি।
পিতার বক্তব্য শোনার পর পরশুরাম উপলব্ধী করে ক্রোধের বশে সে মহাভুল কর্ম করেছে। কিছুদিন পর কীর্তবির্জার্জুনের পুত্র ঋষি জমদগ্নিকে চোরাপথে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। এর পরেই পরশুরাম ক্ষত্রিয় ধ্বংসের পথে নামে। ২১ বারা ক্ষত্রিয় নিধন পর্ব চালায়। এর পরেই সে অনুভব করে, তার একমাত্র কুঠার কিছুতেই হাত ছাড়া হচ্ছে না।
ঋষি মার্কন্ডেয়র পরামর্শ মতে, তিনি লোহিত সাগরে (বর্তমানে নদী) এক দ্বীপে মহাদেবের তপস্যা শুরু করে তার পবিত্র জলে হাত ধোয়ার পরেই কুঠার হাত থেকে খসে পড়ে। মহাভারতে উল্লেখিত পবিত্র লোহিত সাগরই বর্তমানে নদী নামে পরিচিত। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে লেখা মহাকাব্য ও পৌরাণিক গাথায় যা ছিল সাগর, সেই জায়গায় ভৌগলিক প্রকৃতিক পরিবর্তনে নদীরূপ নিয়েছে।
মহাভারতে উল্লেখিত এই লোহিত সাগর কোথায় ?
এই পবিত্র তপোভূমি রয়েছে বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশে। বয়ে চলেছে লোহিত নদী। জায়গাটি বহু বছর ধরে জনপ্রিয় পরশুরাম কুণ্ড নামে। এখানে পর্যটকেরা যান মূলত দুটি কারণে। প্রথম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। দ্বিতীয় এই স্থানের যে প্রাকৃতিক শক্তি রয়েছে তা অর্জন করতে। মকর সংক্রান্তির সময় পরশুরামকুণ্ডে বহু সাধু ও পুণ্যার্থী আসেন এখানে। স্নান সারেন পুণ্য অর্জনের জন্য। তবে তার কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে, সেগুলি ঠিকঠাক মানতে হয়।
এই জায়গার আরও একটি মাহাত্ম্য রয়েছে। আর তা উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে মহাপ্রস্থানিক পর্বে। পাণ্ডবেরা যখন হস্তিনাপুর ছেড়ে স্বর্গের পথ ধরেন, তারা পুরো ভারতর প্রদক্ষিণ করার পর লোহিত সাগরের কাছে পৌঁছন। তখনও অর্জুন মায়াবশত তার গাণ্ডীব ধনু ও দুটি অক্ষয় তুণ ছাড়তে পারেননি। সেই সময় মূর্তিমাণ অগ্নি তাঁদের পথ আটকায়, অর্জুনের কাছে অনুরোধ করে, গাণ্ডীব ধনু ও দুই অক্ষয় তীরকে জলে নিক্ষেপ করতে।
অগ্নি বলেন, আমি সেই অগ্নি যে অর্জুন ও নায়ারণের প্রভাবে খাণ্ডববন দগ্ধ্ব করেছিলাম। কৃষ্ণের সুদর্শনচক্র প্রস্থান করেছে। অর্জুন তোমার গাণ্ডীবের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমি বরুণের কাছ থেকে এই ধনু এনে দিয়েছিলাম, তাই এখনই বরুণকে প্রত্যর্পণ করুন। অগ্নির এই অনুরোধ শোনার পরেই অর্জুন ধনু ও দুই তুণ জলে নিক্ষেপ করেন।
পরশুরাম কুণ্ডের আগে যে ভৌগলিক বৈচিত্র্য ছিল, তা ১৯৫০ সালের ভূমিকম্পে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরশুরামের সেই আদি জায়গাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কীভাবে যাবেন?
বিমানে যেতে চাইলে। প্রথমে ডিব্রুগড় মহানবাড়ি বিমানবন্দর। সেখান থেকে গাড়িতে ২০০ কিমি লোহিত।
ট্রেনে যেতে চাইলে তিনসুকিয়া স্টেশনে নামতে হবে, সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে। ১৬০ কিমি।
বাসে যেতে চাইলে গুয়াহাটি থেকে তিনসুকিয়ার বাস যাচ্ছে। তিনসুকিয়া থেকে পরশুরাম কুণ্ডের সড়ক যোগাযোগ রয়েছে।
*প্রতি বছর মকরসংক্রান্তির সময় এখানে উত্সব হয়। উত্সবে যোগ দিতে হলে আগাম পরিকল্পনার প্রয়োজন।
*এখানে যাঁরা মকরসংক্রান্তিতে পুজো দেবেন তার বিধিকর্ম পদ্ধতি জানতে চাইলে ইমেল করুন- orbitnewsindia@gmail.com লিখুন পরশুরামকুণ্ডের পুজো পদ্ধতি।