অঙ্কোরওয়াট: ইতিহাসের আলোকে এক মহাকাব্যিক স্থাপত্য

কম্বোডিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিয়েম রিপ প্রদেশে অবস্থিত অঙ্কোরওয়াট মন্দির পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় স্থাপনা। খমের সাম্রাজ্যের স্থাপত্যশৈলীর চূড়ান্ত নিদর্শন এই মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় গুরুত্বই বহন করে না, বরং এটি কম্বোডিয়ার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গর্বের প্রতীক। প্রাথমিকভাবে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতি নিবেদিত মন্দিরটি পরবর্তীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

মন্দিরের ইতিহাস

অঙ্কোরওয়াট নির্মাণ শুরু হয় ১২শ শতাব্দীর শুরুর দিকে, খমের রাজা সুর্যবর্মণ দ্বিতীয়র শাসনকালে। এটি নির্মাণে প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম, স্থাপত্য এবং রাজকীয় ক্ষমতার প্রভাব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। মন্দিরটি তৈরি করা হয় হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনীকে ভিত্তি করে।

মন্দিরটি মূলত হিন্দু ধর্মের দেবতা বিষ্ণুর প্রতি উৎসর্গীকৃত হলেও ১৪শ শতাব্দীতে এটি ধীরে ধীরে বৌদ্ধ ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এর কেন্দ্রীয় মিনারটি মাউন্ট মেরুর প্রতীক, যা হিন্দু পুরাণ অনুসারে দেবতাদের আবাসস্থল।

স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য

অঙ্কোরওয়াটের স্থাপত্যশৈলীতে খমের সভ্যতার সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ প্রকাশ পায়।

মন্দিরের বিন্যাস: তিন স্তরের গ্যালারি এবং পাঁচটি স্তূপের সমন্বয়ে মন্দিরটি তৈরি। কেন্দ্রীয় মিনারটি ৬৫ মিটার উঁচু।

বেস-রিলিফ: মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ, মহাভারত এবং সমুদ্র মন্থনের কাহিনী খোদাই করা হয়েছে।

জলাশয়: মন্দিরের চারপাশে ৫ কিলোমিটার বিস্তৃত একটি পরিখা রয়েছে, যা প্রতিরক্ষার পাশাপাশি প্রতীকী অর্থ বহন করে।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

অঙ্কোরওয়াটের আশেপাশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন স্থাপনা ও প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে, যা ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে।

অঙ্কোর থম:
খমের সাম্রাজ্যের রাজধানী অঙ্কোর থম মন্দির নগরী। এখানে অবস্থিত বায়ন মন্দির, যা ২০০টিরও বেশি মুখমণ্ডলের খোদাইয়ের জন্য বিখ্যাত।

তা প্রহম মন্দির:
প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে থাকা এই মন্দিরটি বটগাছের শিকড়ে ঢেকে রয়েছে। এটি চলচ্চিত্র “টম্ব রাইডার”-এর দৃশ্যপট হিসেবে বিখ্যাত।

বানতায় স্রেই:
মহাকাব্যের বর্ণনায় ভরা এই মন্দিরটি সূক্ষ্ম বালিপাথরের খোদাইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ।

তোণলে সাপ লেক:
কম্বোডিয়ার বৃহত্তম মিঠাপানির লেক, যেখানে ভাসমান গ্রাম এবং স্থানীয় জীবনযাত্রা দেখা যায়।

ভ্রমণ টিপস

ভ্রমণের সেরা সময়: নভেম্বর থেকে মার্চ, শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য।

কীভাবে যাবেন: সিয়েম রিপ শহর থেকে টুকটুক বা বাইসাইকেলে সহজেই অঙ্কোরওয়াটে পৌঁছানো যায়।

প্রবেশ মূল্য: বিদেশি পর্যটকদের জন্য টিকিট সিস্টেম রয়েছে (একদিন, তিনদিন, অথবা সাতদিনের টিকিট)।

গাইডের প্রয়োজন: ইতিহাস এবং খোদাইকৃত গল্পগুলো বোঝার জন্য একজন স্থানীয় গাইড নিয়ে নেওয়া ভালো।

উপসংহার

অঙ্কোরওয়াট শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি খমের সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উত্তরাধিকারের এক চিরন্তন স্মারক। মন্দিরের প্রতিটি অংশ যেন প্রাচীন খমের সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা বলে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ, জটিল স্থাপত্য, এবং ঐতিহাসিক গল্প পর্যটকদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। সিয়েম রিপে ভ্রমণের সময় অঙ্কোরওয়াট ও এর আশেপাশের স্থানগুলো অবশ্যই আপনার তালিকায় থাকা উচিত।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

চলুন বেড়িয়ে আসি ভিয়েতনামের আনাচে কানাচে পর্ব ১

ভিয়েতনামের হো চি মিন শহর: দর্শনীয় স্থান ও পরিবহন ব্যবস্থা ভিয়েতনামের বৃহত্তম ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!