আজ যে ঘটনার কথা বলতে চলেছি, তা ঘটেছিল প্রকাণ্ড কানাডিয়ান লেকের একটি নির্জন দ্বীপের মধ্যে। জায়গাটা ছিল মন্ট্রোল থেকে টরোন্টো যাওয়ার পথে। দ্বীপে যাওয়ার উপায় নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলছি না, তবে ওখানে ছিলাম প্রায় হপ্তা দুয়েক সেই সময় আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল, সেটাই বলতে চাই।
প্রায় ২০ বছর আগের কথা। তখনও আমার কলেজের পড়াশুনা চলছে। সেই সময় একটা অভিযাত্রী দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলাম বেড়াতে। উদ্দেশ্যটা ছিল, একটা নির্জন জায়গায় লম্বা সময় কাটানো, আর সেই ফাঁকে গুরুত্বপূর্ণ সিলেবাসের অংশ শেষ করে নেওয়া। কারণ, গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি একটুও পড়াশুনার প্রতি যত্নবান হইনি।
সময়টা ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ। ঝিল জুড়ে বড় ট্রাউট এবং মাক্সিনঞ্জে মাছ, জল তোলপাড় করছে। উত্তরের খোলা হওয়ায় লেকের জলতরঙ্গের খেলা। মৃদু বাতাসের দমকা হাওয়ায় শীতল হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। চারপাশে সারি সারি ম্যাপেল গাছের ডাল থেকে খসে পড়ছে সোনালী পাতা। শরতের আগমনে প্রকৃতি যখন খুশিতে ডগমগ, সেই লেকের কিনারে আশ্রয় নেওয়া বুনো হাঁসের দল খেলায় মেতেছে। ওদের দেখে কে বুঝবে, গত গ্রীষ্মে ওদের আর্তনাদ কতটা হৃদয় বিদারক ছিল।
পুরো দ্বীপটায়, কোনও জনমানস নেই। থাকেও না এখানে কেউ। যদিও জায়গা দখল করে আছে একটি দোতলা কাঠের কটেজ। কটেজটি দ্বীপ ও লেকের পাড় লাগোয়া, সেখানে বাঁধা আছে একটি ছোট নৌকা। আর আশে পাশে দেখা মেলে কিছু কাঠবিড়ালির দল খেলা করছে। শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এক নির্জন, নিস্তব্ধ, নিসঙ্গতার আজব স্বপ্নপুরী। সপ্তাহে একদিনই মাত্র আশে পাশের দ্বীপ থেকে কিছু কৃষক আসে, যারা ডিম আর পাউরুটি ও প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করে যায়।
কথা ছিল এই দ্বীপে দুটো রাত কাটিয়ে আবার রওনা দেওয়া। কিন্তু আমি স্থির করলাম, একমাত্র এই নির্জনতাই আমার পড়াশুনার পক্ষে আদর্শ। পুরো দলকে জানিয়ে দিলাম, আমি রইলাম। ওরা যখন এই পথ ধরে ফিরবে, তখন আবার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেব। যাওয়ার সময় বন্ধুরা একাধিকবার সতর্কবাণী দিয়েছিল, স্থানীয় উপজাতিদের আনাগোনা আছে এ দ্বীপে। শহুরে অপরিচিতদের হামলা চালালে বাঁচনোর কেউ নেই। সতর্ক বার্তাকে উপেক্ষা করে, তাদের বিদায় জানিয়ে কিছুটা জেদের বশেই রয়ে গেলাম।
কটেজের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বন্ধুদের নৌকা, লেকের খাঁড়ি পথ ধরে মিলিয়ে গেল। গত দুদিন, এই দ্বীপে কেটে গিয়েছে, মনে হয়েছিল যেন শহুরে ব্যস্ত জীবনের চেনা ছন্দেই কাটছিল, হই হট্টগোল, কোলাহল সবটাই ছিল। এখন পুরোপুরি শান্ত। এক আশ্চর্যরকমের নীরবতা যেন আচমকাই নেমে এলো পুরো দ্বীপটায়।
আশে পাশে প্রায় ছ- সাত মাইল দূরে আর কোনও দ্বীপ নেই। শহর থেকে এই দ্বীপে আসার আগে একটা বড় গভীর জঙ্গল পড়ে, সেটাও ছাড়িয়ে এসেছি প্রায় দু মাইল আগে। কাছে পীঠে কেউ নেই, কোনও জনমানসের বা মানব সভ্যতার লেশ মাত্র নেই। দ্বীপের মধ্যে লম্বা লম্বা ম্যাপেল গাছ আর পাথরগুলোই যেন এক একটা মানবচরিত্র হয়ে উঠতে শুরু করলো। তাদের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলা শনশনানি উত্তরে হাওয়ার শব্দ, যেন অট্টহাসিতে মেতে উঠছে।
এক ঘণ্টা হয়ে গেল বন্ধুরা বিদায় নিয়েছে, নির্জনতার মধ্যে মনে হতে লাগল যেন দু মাস কেটে গিয়েছে। এখানে সময় যেন থমকে যায়। নির্জন দ্বীপে নিজের নাম নিয়ে কয়েকবার চেঁচিয়েছি। দ্বীপের পাথরে ধাক্কা খেয়ে সেই শব্দের প্রতিধ্বনি এতো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল, যে তাতে আমি নিজেই কয়েক বার চমকে উঠেছিলাম। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল, অন্য কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে।
এখানে বন্ধুদের সঙ্গে দু দিন কাটালেও, হৈ হট্টগোলের মাঝে, কটেজের পুরোটা ঘুরে দেখাই হয়নি। ওরা চলে যাওয়ার পর কটেজে ফিরলাম। কটেজটার মধ্যে মোট ছটি ছোট ঘর রয়েছে। প্রত্যেকটি ঘর, পাইন কাঠের তক্তা দিয়ে দেওয়াল করা হয়েছে। সব ঘরেই, কাঠের খাট, একটি করে ম্যাট্রেস এবং চেয়ার রয়েছে। শুধুমাত্র দুটি ঘরে রয়েছে আয়না। তার মধ্যে একটি ভাঙা।
কটেজের মেঝে পুরো দস্তুর কাঠের। ফলে হাঁটাহাঁটি করলেই একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ বেরোতে থাকে। আর নির্জনতার মাঝে সেই শব্দটা যেন একটু বেশিই কানে ধরা দিচ্ছিল। কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত পুরো কটেজটা গমগম করছিল হৈ, হট্টগোলে। তাদের কিছু ফেলে রাখা জিনিস এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কটেজে, এক এক মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এইতো তারা এক্ষুনি এসে পড়বে। কিন্তু আমি যে একা, সেটা বিশ্বাস করতেই একটু যেন অসুবিধা হচ্ছিল।
কটেজের একটা ঘরের দরজার দিকে চোখ গেল, বোধ হয়, দরজাটা খোলাই হয়নি। সেটাকে বেশ ক্ষানিক্ষণ টানাটানি করে দেখলাম, খোলা যাচ্ছে না। এক মুহূর্তে কেমন যেন মনে হল, ভেতর থেকে কেউ যেন দরজাটাকে টেনে ধরে আছে। আবার একবার চেষ্টা চালালাম, এবার মনে হল, দরজা আচমকা খুলেই যেন এক জোড়া অপরিচিত চোখ আমার মুখে সামনে এসে পড়বে। এই ভাবনাটা আসার পরেই, দরজাটাকে পুরনো হালেই ছেড়ে দিলাম।
কটেজটাতে একটা চক্কর মেরে, একটা ছোট্ট রুম বাছাই করে নিলাম, রাতে নিজের মতো করে ঘুমোনোর জন্য। রুমটা ব্যালকনি লাগোয়া, পাশে ছাদ বারান্দা। ঘরটা ছোট হলেও, খাটটা বেশ বড়। অন্য রুমে খাটে পাতা বিছানাগুলোতে যে গদি রয়েছে, তাদের মধ্যে এই বিছানার গদিটা সবচেয়ে ভালো লাগলো। দোতলার এই ঘরটা নীচের সিটিং রুমের ঠিক উপরে, মানে নীচের তলায় যেটাকে আমি আমার পড়ার ঘর বানিয়ে নিয়েছি। দোতলার রুমটার পুব দিকে একটা ছোট জানলা রয়েছে, ঘুম থেকে উঠলেই সোজা সূর্য উদয় দেখা যাবে।
বারান্দার পাশ দিয়ে একটা সরু সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে, সেটা গিয়ে মিশেছে, একটা গাছের কাছে, যেখানে লোকের পাড়ে ডিঙি নৌকাটা বাঁধা আছে। পুরো দ্বীপ জুড়ে, ম্যাপেল, হেমলক, সিডার গাছের গভীর অরণ্য। গাছগুলি পুরো কটেজটাকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে। বেশ কিছু গাছের ডাল, কটেজের দেওয়ালে এসে ঠেকেছে, কিছু ডাল নুয়ে পড়েছে কটেজের ছাদে। ঘন গাছের ঘেরাটোপে আড়ালে। কটেজে অন্ধকার যেন একটু তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে এলো, সূর্যাস্তের পর পুরো দ্বীপ জুড়ে এক অদ্বুত আঁধার গ্রাস করতে লাগল।
কটেজ ঘুরে দেখার পাশাপাশি বাকি দিনটা কিছু জিনিস গোছ গাছ করতে গিয়েই কেটে গেল। তাঁবু থেকে কিছু জিনিস, সিটিং রুমে নিয়ে গেলাম। কিছু কাঠ কেটে জোগাড় করে রাখলাম, রাতের খাবার তৈরি থেকে শুরু করে ঠান্ডা দূর করতে কাজে লাগবে। গভীর রাতের দিকে, এখানে ঠান্ডা একটু বেশি পড়ে।
সন্ধে হওয়ার আগে, ছোট ডিঙিতে চেপে দ্বীপের চারপাশটা এক পাক ঘুরে এলাম। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, যা আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। পুরো নির্জন দ্বীপে, ধীরে ধীরে গ্রাস করছে অন্ধকার, আর আমি একা একটা নৌকায় চেপে দ্বীপের খাঁড়ি ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
সূর্য পুরোপুরি অস্ত যায়নি, গভীর জঙ্গলের দাপটে আলোর ক্ষীণ কিরণ প্রবেশ করছে মাত্র, চারপাশটা হাল্কা কুয়াশার চাদর ঘিরে ধরেছে। নৌকা নিয়ে কটেজের সামনে যখন ফিরে এলাম, তখন মনে হল, আরও বেশি নির্জন হয়ে উঠেছে দ্বীপটা। নানা পাখির আওয়াজ যেটা বিকেল পর্যন্ত ভেসে আসছিল, সেগুলি মিলিয়ে গিয়েছে। মনে হল, জঙ্গলের অধিকাংশ পাখি এখন শীতঘুমে। কানাডার এই উত্তরে গোধূলিবেলা বলে কিছু হয় না। অন্ধকারটা আচমকাই নেমে আসে।
ঘাটের কাছে নৌকাটা বেঁধে, কটেজের মূল দরজার দিকে যেতেই চোখে পড়ল, সামনের ঘরের ছটি বাতি জ্বলছে, যাওয়ার সময় ওগুলো জ্বেলে দিয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু রান্নাঘরে, আলোর রেখা এমন এসে পড়েছে, যা পুরো দস্তুর আঁধারই বলা ভালো। রান্নাঘরের ফেটে যাওয়া কাঠের ছাদ দিয়ে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে।
সেদিন রাতে একটু তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলাম। জানলার ফাঁক দিয়ে, ঘরের ভেতর তেমন বাতাসের আনাগোনা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু বিছানার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর বাইরে মৃদু জলের ঢেউ পাথরের গায়ে ধাক্কা লাগার আওয়াজ ভেসে আসছিল। চোখ খুললেই, হাল্কা মিহি চাঁদের আলোর সঙ্গে এক আশ্চর্য রকমের নিস্তবদ্ধতা যেন গ্রাস করছিল। সেই সঙ্গে পাশের ঘর আর বারান্দা থেকে কিছু শব্দ ভেসে আসছিল, যেন কেউ বা কারা বারান্দায় পায়চারি করছে, ফিসফিস করে কথা বলছে। জামাকাপড় ঝাড়ার ক্ষীণ আওয়াজ। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ, বাইরে থাকে ভেসে আসা শব্দ শুনতে শুনতে, চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো, সব শব্দ মিলে মিশে গেলে স্বপ্নের মধ্যে।
একটা সপ্তাহ কেটে গেল এই ভাবেই। পাশাপাশি পড়ার সময়ও অনুভব করলাম, অতি দ্রুত সব কিছুই মগজে থেকে যাচ্ছে। তবে দশ দিনের ঠিক মাথায় একটা ঘটনা ঘটল। গভীর রাতে আচমকাই ঘুমটা ভেঙে গেল। বেশ কয়েক মিনিট উঠে বসে রইলাম। ঘরের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। একটা বদ্ধ ঠান্ডা বাতাসের দল যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে।
একটা চাপা আতঙ্ক যেন আমার মাথায় চেপে বসতে শুরু করলো, মনে হল, ঘরের মধ্যে এমন কিছু আছে, যার জন্য এই অস্বস্তি বোধ। গায়ে জামাটা চাপানোর সময়, খেয়াল করলাম, একবার নয় দু বার শরীরে কেমন একটা অদ্ভুত কাঁপুনি দিল। ঘরের মধ্যে আর এক মুহূর্ত না কাটিয়ে বাইরের ঘরে চলে এলাম। যখন আমি ছোট প্যাসেজ পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে রান্না ঘরের দিকে এলাম, ঠিক তখনই একটু স্বস্তি অনুভব করলাম। সেদিনের মতো রাতটা রান্না ঘরেই কাটিয়ে দিলাম।
পরে দিন সকালে ব্রেকফাস্ট বানানোর সময়, আগের রাতের ঘটনাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে করার চেষ্টা করলাম। গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়া, এবং ঘরের মধ্যে অস্বস্তি ও খারাপ লাগার কারণ কী থাকতে পারে! এই গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুতুড়ে শব্দ কানে এলো।
শব্দটা আসছিল করিডরের দিক থেকে। কাঠের মচমচানি একটা শব্দ, আমি নিশ্চিত হলাম, ঘরের মধ্যে আমি ছাড়াও দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির উপস্থিতি রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত বন্দুকটা নিয়ে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলাম, নীচে গিয়ে দেখলাম দরজা ও জানালা বন্ধই আছে। তবে মেঝেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা গুবরে পোকা।
জলখাবারের পর, নীচের চলায় বসে ঘণ্টা দুয়েক পড়াশুনা চললো। কিন্তু ঠিক ঠাক যেন মন বসছিল না। লেকের জলে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা চললো ঘণ্টা খানেক। এ সবের মাঝেও, মাঝে মধ্যে প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছিল, আগের দিন রাতে ঘরের মধ্যে আচমকা অস্বস্তি বোধ হওয়ার কারণটা ঠিক কী ছিল। একটা বই আনতে উপরের তলায় একবার গেলাম, আগের দিন রাতে যে ঘরটায় ছিলাম, সেই ঘরে ঢোকা মাত্রই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল।
বিষয়টা অত্যন্ত সচেতন ভাবেই খেয়াল করলাম। ঘরে ঘোকা মাত্রই একটা অস্বস্তি আর চাপা আতঙ্ক গ্রাস করতে লাগল। বইটা নীচে নিয়ে এসে, পড়তে বসেও আর ইচ্ছে করলো না। তার বদলে সারা দুপুরটা, ক্যানয়ে চেপে দ্বীপের আশে পাশে ঘুরে বেড়ালাম আর মাছ ধরলাম। সূর্য অস্ত যেতে ফিরে এলাম কটেজে। বেশ অনেকগুলো ব্ল্যাক বাস মাছ নিয়ে এসেছি, কিছু আজকের নৈশভোজে সদগতি হবে, কিছু ভেজে তুলে রাখা হবে, কালকের জন্য।
গত রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি, আর ঘুম ভালো না হলে, সকালে পড়াশুনার ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়ে, বারে বারে হই উঠতে থাকে, কেমন যেন ক্লান্তি বোধ হয়। ফলে আজকের রাতে, নীচে পড়ার ঘরেই শোয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। মনে হতে লাগল, অকারণ ভয়ের জন্য ঘর বদল করতে বাধ্য হচ্ছি! নিজের মনকে যুক্তি দিলাম, রাতে একটা টানা লম্বা ঘুমটা খুব জরুরি, নয়তো পড়ার ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে। পরিকল্পনা মতো, নীচে বসার ঘরেই জুতসই শোয়ার বন্দোবস্ত করলাম। দরজার দিকে মুখ করে, ঘরের একটা কোনায় বিছানা পেতে ফেললাম।
রাত আটটা। রান্না ঘরের ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার শব্দটা, সমস্ত নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে নিজের ছন্দে প্রকট হয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে, বাসনপত্র ধুয়ে রান্না ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসার ঘরে ঢুকলাম। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে একবার চেখ গেল। পুরো দ্বীপ জুড়ে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার যেন এক আশ্চর্য কনসার্ট শুরু হয়েছে।
বাইরে কোনও বাতাস খেলা করছে না, এমনকি লেকের জলটাও আশ্চর্যরকমের স্থির। রূপোলী চাঁদের হাল্কা ক্ষীণ আলো এসে পড়ে লেকের জলে। আকাশে একটা নিকশ কালো বাদলের জমাট চাদর যেন ঝুলে রয়েছে। যেন এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমে আসার প্রস্তুতি চলছে আকাশে।
চারপাশ থমথমে পরিবেশ। এতো কিছু দেখা, উপলব্ধীর পরেও, মাথাটা বেশ ঝরঝরে লাগছে, তেমন কোনও অস্বস্তি নেই। বরং এটা ভেবেই ভালো লাগছিল, আগামিকাল সকালে পাশের দ্বীপ থেকে বৃদ্ধ কৃষ্কটা আসবে, ডিম আর পাউরুটি দিয়ে যাবে। পুরো দ্বীপ জুড়ে পরতে পরতে নেমে আসছে নিস্তব্ধতার গাঢ় রূপ। রান্না ঘরের ঘড়ির কাঁটার শব্দ যেন অশ্বখুরের ধ্বনি। আমি একটা বই বন্ধ করে আরও একটা বই খুললাম।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে পড়াশুনা চললো। কিন্তু কেন জানি না, মনে হল, আমি একই প্যারা দুবার পড়ছি, অথচ একটা প্যারা দু বার পড়ার কোনও কারণও নেই। খেয়াল করলাম, পড়ার সময়ই, মনটায় অন্য কিছু একটা চিন্তা এসে ভিড় জমাচ্ছে, পরক্ষণে যখন সচেতন হচ্ছি, ঠিক কোন চিন্তায় হারিয়ে যাচ্ছি তা অবশ্য মনে করতে পারছি না। এমনকি বইয়ের যে অংশটা পড়লাম, সেটাও যেন মনে করতে পারছি না। আরও একটা বিষয় নজরে এলো, আমি বইয়ের পাতা একটার বদলে কখন যেন দুটো করে পাল্টিয়ে ফেলেছি।
পড়তে বসে এতোগুলো বিষয় যখন নজরে ধরা দিল, তখন আর কিছুই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছিলাম না। এই ঘটনাগুলোর পিছনে কি কোনও অশুভ শক্তি কাজ করছে! শরীরে কোনও অসুস্থতা বোধ করছি না। বরং মনটাও আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন। সবকিছু মনের ভুল ভেবে, আবার পড়ায় মন দিলাম, এখন সম্পূর্ণ মনযোগ পুরোপুরি বইয়ের দিকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর খেয়াল হল, আমি পড়ার বদলে চেয়ারে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টে জানলার বাইরে আকাশের দিকে চেয়ে আছি।
আমার অবচেতন মনে নিশ্চিত ভাবে কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা কাজ হয়তো করতে ভুলে গেছি। কী সেই কাজ, যার জন্য মন বার বার অন্যদিকে চলে যাচ্ছে! মনে হল, রান্না ঘরের দরজা আর জানলাগুলো ঠিকঠাক হয়তো বন্ধ করা হয়নি, গিয়ে দেখলাম, সেগুলো বন্ধ আছে, একদম ঠিকঠাক। ঘরের বাতিগুলোও ঠিক ঠাক জ্বলছে, উপরতলায় প্রত্যেকটা ঘর একবার ঘুরে দেখলাম, সব কিছুইতো ঠিকঠাক আছে। কোথাও কোনও গণ্ডগোলতো হয়নি! সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। তবু কোথাও যেন একটা ভুল হচ্ছে, আর এই ভাবনাটাই যেন আরও জোরালো হয়ে জাঁকিয়ে বসছে আমার মনে।
পড়তে বসার জন্য যখন উপরের তলা থেকে নীচের তলায় নেমে এলাম, ঠিক তখন অনুভব করলাম, নীচের ঘরটা যেন কেমন অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা। অথচ ঘরটা সারা দিন বেশ উষ্ণই ছিল। সন্ধে নাগাদও তেমন ঠান্ডা ছিল না। ঘরের মধ্যে ছটি বড় বাতি জ্বলছে, ঘরটা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এতোটা ঠান্ডা হওয়ার কথাও নয়। বোধ হয় লেকের জোলো হওয়ার জেরে ঘরটাকে ঠান্ডা করে তুলেছে। বারান্দায় গিয়ে কাচের দরজাগুলো বন্ধ করে দিলাম।
বারান্দার জানলা বন্ধ করে মুখটা ঘুরিয়েছি, কেমন যেন একটা মনে হল, কাচের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ গেল। কটেজের বাইরের ক্ষীণ আলো, লেকের জলের পাড় জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এক আলো আঁধারি পরিবেশে। চোখে পড়ল লেকের উত্তর দিক থেকে একটা আলোর রেখা এসে পড়েছে পাড়ে, ঠিক যখানে ডিঙি নৌকাটা বাঁধা ছিল। আর সেই আলোর স্রোত ধরে একটি ডিঙি নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্ধকারের দিকে।
পুরো দৃশ্যটাই আমার কাছে আশ্চর্যের লাগলো, কারণ, এতো রাতে কোনও অভিযাত্রী ডিঙি নৌকা করে জলপথ পার করে না। আর নৌকাটা যে পথে যাচ্ছে, সেই পথে কাছে পীঠে অন্য কোনও দ্বীপও নেই। গ্রীষ্মে যে সমস্ত অভিযাত্রীর দল এ পথ ধরে গিয়েছিল, তারাও সপ্তাহ খানের আগে ফিরে গিয়েছে তাও দিনের আলোয়।
পড়াতে মন বসল না, বারবার এই অদ্ভুত দৃশ্যটার কোনও যুক্তি সাজাতে পারছিলাম না। কালো জলের মধ্যে ক্ষীণ আলোরেখার পথ ধরে একটা নৌকা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, এই ছবিটাই বারবার আমার মনে আসছিল। পড়ার বইয়ের পাতায় কালো হরফেও যেন ওই ছবিই দেখতে পাচ্ছিলাম। অগত্যা বই বন্ধ করে, একবার বারান্দার দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। আড়মোড়া ভেঙে লেকের জল, আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।
গভীর রাত যেন থমকে গিয়েছে। বারান্দা থেকে বেরিয়ে সরু এক ফালি রাস্তা লেকের ঘাটের কাছে মিশেছে। সেই পথ ধরে একটু এগোতেই হোঁচট খেলাম। ঠিক এমন সময় নিস্তব্ধতা চুরমার করে একটা প্রচণ্ড শব্দ কানে এলো, আশে পাশে কোথাও গাছ ভেঙে পড়ল। হাল্কা শনশনানি হওয়া যেন খেলে গেল পুরো দ্বীপটা জুড়ে। শব্দের রেশটা বেশ কয়েক সেকেন্ড জুড়ে মাতাল করে রাখল।
প্রায় ঘাটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। সিটিং রুমের আলো, দরজা জানলা ভেদ করে কিছুটা ছড়িয়ে এসেছে ঘাটের কাছে। চোখে পড়ল আরও একটা ডিঙি নৌকা, লেকের কালো জল কেটে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে অন্ধকারের দিকে। ঠিক সেই দিক থেকে একটা ক্ষীণ আলোর স্রোত বয়ে আসছে। এবারও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল নৌকাটা। তবে আগের বারের তুলনায়, এবারের দৃশ্যটা ছিল আরও প্রকট। তবে মনে হল, এবারের নৌকাটা আগের তুলনায় একটু যেন বড়, একজনের বদলে দুজন নৌকায় ছিল, বোধ হয় স্থানীয় উপজাতিদের নৌকা।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছি, আবার একটা ডিঙি নৌকা পার হচ্ছে, এবারের ছবিটা আগের দুটোর থেকে আরও স্পষ্ট। নৌকাটা দ্বীপের যেন অনেকটা কোল ঘেঁষে যাচ্ছে। ডিঙি নৌকার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে এক লহমায় মনে হল, তিনটি আলাদা নৌকা নয়। একটা নৌকাই, পুরো দ্বীপটাকে চক্কর দিচ্ছে, আর ক্রমেই দ্বীপের পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। এতো রাতে দ্বীপের চারপাশে দুটো উপজাতির লোক নৌকা নিয়ে চক্কর কাটছে, মতলবটা কি!
ঘটের কাছে ঘরের আলোটা এসে পড়েছে, ঠিক পিছন দিকে একটা বড় পাথর রয়েছে, সে দিকটা অন্ধকার। আমি সেই পাথরের পিছন দিকে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। আবার নৌকাটা যদি আসে, তার আরোহীরা যাতে আমাকে দেখতে না পায়, অথচ আমি যেন তাদের স্পষ্ট দেখতে পাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আবার নৌকাটা এলো। এবার পাড়ের অনেকটা কাছে। ইঙ্গিত স্পষ্ট, আমার বন্ধুরা সতর্ক করেছিল, স্থানীয় উপজাতিদের আক্রমণ যে কোনও মুহূর্তে আসতে পারে। নৌকাটা আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
আমি আর অপেক্ষা না করে, সোজা এই ফাঁকে ঘরে চলে এসে, আমার মার্টিন রাইফেলটা তুলে নিলাম। ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপচাপ দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি নিশ্চিত এবার স্থানীয় উপজাতিরা, এই দ্বীপেই আক্রমণটা চালাবে। পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার আর নিস্তবদ্ধতা। আর সেই নৈশব্দ ভেদ করে শোনা যাচ্ছে কেবল, রান্না ঘরের ঘড়ির কাঁটার আওয়াজ, আমার দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস ও দ্রুত গতিতে চলা হৃতপিণ্ডের শব্দ। তবু কানটাকে সজাগ করে রাখলাম। ঘাটের কাছে নৌকা এসে ভিড়লেই, জলের শব্দটা শোনা যাবে। নজর রাখলাম জানলার বাইরের দিকে, বাইরের ক্ষীণ আলোতে মানুষের অবয়ব কিছুটা হলেও ধরা পড়বে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমার আশঙ্কা সত্যি হল। ঘাটের কাছে জলের শব্দটা যেন একটু বেশি প্রকট হচ্ছে, জানলার দিকে সামান্য উঁকি মেরে দেখি, দুটো লোক নৌকাটিকে পাড়ের কাছে বাঁধছে। আর বাইরে হাল্কা ঝড়ের উপস্থিতি। কটেজ লাগোয়া গাছগুলোর ডাল একটু বেশি মাত্রায় দোলা খাচ্ছে। ধীরে ধীরে দুটো লোকের হাঁটার শব্দ প্রকট হতে লাগলো, বুঝতে অসুবিদা হল না। ওরা কটেজের মূল দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি প্রায় শ্বাস বন্ধ করে দরজার কোনায় বন্দুকটাকে শক্ত করে ধরে শিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
মিনিট খানের মধ্যে বাইরের ক্ষীণ চাঁদের আলো ধারা, কাচের জানলা ভেদ করে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে, মাটিতে পড়া সেই আলো আড়াল করে দাঁড়াল একটা কালো ছায়া মূর্তি। বুঝতে অসুবিধা হল, আমার থেকে বিপদের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির দেওয়াল। স্থানীয় উপজাতিরা, ভয়ঙ্কর ও প্রচণ্ড হিংস্র, তাই আগাম আক্রমণের কথা মাথাতেও আনলাম না, একমাত্র সরাসরি হামলা না হলে, যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে ও লুকিয়ে রাখা যায়, ততটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
দরজাটায় একবার ধাক্কা দিল, আমি আরও সতর্ক হলাম। দু তিনবার টান দিয়েও খুলতে পারল না। এরপর তিনিকের নীরবতা। তার পরেই খেয়াল করলাম, বসার ঘর লাগোয়া বারান্দার শেষের জানলাটার দিকে ধাক্কাধাক্কি চলছে। অর্থাত জানলা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা চালাবে ওরা। মনে মনে একবার নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, সন্ধের দিকে সব জানলাগুলো বন্ধ করেছিলামতো! বেশ মনে পড়ছে, প্রত্যেকটা জানলাই বন্ধ ছিল।
এটা ভেবে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে যাবো, আচমকা একটা হ্যাঁচকা টানে বারান্দার শেষের জানলাটা খুলে গেল। আর শুরু হল, বিদ্যুতের চমক ও বাজ পড়ার শব্দ। এক ঝলকে এবার যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম লোকদুটোকে। প্রকাণ্ড লম্বা, তবে একজন অবশ্য তুলনায় কম লম্বা। কালো দৈতাকার চেহারা। গালগুলো চোয়াড়ে, চওড়া কাঁধ, আশ্চর্যরকমের অবয়ব। আপাত দৃষ্টিতে মানুষের মতো লাগলেও, তারা যেন আদপে মানুষ নয়। মানবের আলদা থাকা কোনও হিংস্র প্রাণী। ওরা দুজনেই এখন ঘরের ভেতরে। পায়ের শব্দে ওদের বিচরণ বুঝতে পারছি। ধীরে ধীরে ওরা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তাহলে কি ওরা বুঝতে পেরে গিয়েছে আমার উপস্থিতি!
নিজের রাইফেলটা শক্ত করে ঘরে একদম পাথরের মতো দরজার পাশে বসে রইলাম। যতটা শিঁটিয়ে কুঁকড়ে থাকা যায়, তার চেষ্টা করলাম। আমাকে অতর্কিকে হামলা করলে, একটা ফায়ারে একজনকে ঘায়েল অথবা খতম করতে পারবো, কিন্তু অন্যজনকে সঙ্গে সঙ্গে কতটা কাবু করতে পারবো জানি না।
সিটিং রুমে ওরা দুজনেই পায়চারি করে যাচ্ছে, যেন কিছু একটা খুঁজছে। ঘরের প্রত্যেকটা কোনা, টেবিলের তলা, ওয়াড্রব খুলে দেখছে। একটা সময়ে ওদের একজন আমার অনেকটাই কাছে চলে এলো, দূরত্ব বলতে ছ ফুট! দ্বিতীয় জন যেন হ্ল্কা হাঁক পাড়ল, সেই সময়ই আরও একবার বিদ্যুতের চমকে ওদের দেখতে পেলাম। ওই কম লম্বা লোকটা, ইশারা করে দোতলার দিকে দেখাচ্ছে। দুজনেই, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে গেল।
নীচের তলায় কোনায় চুপচাপ বসে শুনতে পাচ্ছি, দুজনে উপরের তলায় খুব দ্রুত গতিতে হাঁটা চলা করে কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক বাদে, শব্দটা থেকে গেল। সম্পূর্ণ নীরবতা। মিনিট খানেকের মধ্যে আবার ধীর পায়ে হাঁটার শব্দ। এবার শব্দ আসছে ঠিক রান্না ঘরের উপর তলা থেকে। সেই ঘর, যেটা বন্ধ ছিল, উপরের তলায় আমি একবার খোলার চেষ্টা করেছিলাম, মনে হয়েছিল, যেন কেউ ভেতর থেকে টেনে ধরে আছে।
স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ওরা দরজাটা কয়েকবার ধাক্কা ধাক্কি করে খুলে ফেলেছে। আর সেখান থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে আসছে। বড় কিছু, ছোট আলমারি! কোনও বস্তা বা কোনও বড় গাছের ডাল। ওই জাতীয় কিছু। দোতলায় কাঠের মেঝেতে টেনে আনার শব্দ পাচ্ছি, কিন্তু সেটা ঠিক কী, তার কোনও যুক্তি সাজাতে পারলাম না। তবে যাই টেনে আনুক, সিঁড়ি পথে নীচে নামাতে চলেছে। শব্দটা শুনে আন্দাজ করতে পারলাম।
ঘন অন্ধকারে শুধু সজাগ আমার কান। আর বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোয় চোখে যতটুকু ছবি ধরা পড়ে, তার নির্যাস নিয়েই পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ইঙ্গিত রচনা হতে থাকে মস্তিষ্কের অন্দরে। এবার খেয়াল হল, চূড়ান্ত ভয় আর উত্তেজনায় আমি এতোটাই কুঁকড়ে গিয়েছি যে আমার হাত, পা, শরীর অবশ হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে যেন শক্তি হারিয়ে ফেলছি। দুটো লোক যে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল, সেই জানলা দিয়ে ঢুকছে বাইরের শব্দ। বাজ পড়ার শব্দ, বাইরে ঝড়ের শব্দ, সেই সঙ্গে দোসর হয়েছে, বৃষ্টির শব্দ। লেকের জলটাও যেন ফুঁসতে শুরু করেছে। ঘাটের কাছে বাঁধা দুটো ডিঙি নৌকা একে অপরকে ধাক্কা মারছে।
এবার ওরা দুজনে কি একটা টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামাচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। আরও একবার বিদ্যুতের ঝলক না এলে বোঝাও যাবে না। তবে বেশ বড় কিছু যে নামাচ্ছে, তা স্পষ্ট। আরও একবার বিদ্যুতের ঝলকের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল ঘর। স্পষ্ট ধরা দিল চোখে, এক ব্যক্তির দেহ।
দুজনে দু দিকে দাঁড়িয়ে টান মারতে মারতে নীচে নামিয়ে আনছে। দৃশ্য দেখে শরীর আরও শিথিল হতে শুরু করলো। আমার হৃতপিন্ড যেন দুরন্ত ঘোড়ার মতো প্রবল বেগে দৌড়তে শুরু করেছে। দমকা হাওয়ার মতো একটা ভাবনা এসে জুড়ে বসলো, প্রায় ১০ দিন এই দ্বীপে কাটিয়েছি, দো তলায় যে ঘরের দরজাটা খোলার চেষ্টা করেছিলাম, সেই ঘরেই কি কোনও লাশ রাখা ছিল!
ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে উঠল, প্রচণ্ড ব্যাথায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম নাকের কোল বেয়ে ঝড়ে পড়ছে, কিছু অংশ চোখে ঢুকছে, জ্বালা করছে, কিন্তু সেটা মোছার মতো, শক্তি সঞ্চয় করতে পারছি না। আর নতুন করে নিজেকে সাহসও যোগাতে পারছি না। ওরা দেহটাকে অনেকটাই টেনে নিয়ে এসেছে।
একদম দরজার কাছে। হয়তো দরজা খুলে এবার দেহটা টেনে বাইরে নিয়ে যাবে। আবার বিদ্যুতের আলোটা এলো, আমার থেকে ওদের দূরত্ব এখন মাত্র পাঁচ ফুট। খুব কাছে, কিন্তু বিদ্যুতের আলোয় যে ছবি ধরা পড়ল, তা আমার কাছে প্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। ওরা যে দেহটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা চিনতে পারলাম। ওই দেহের মুখটা ছিল আমার নিজের।
এক ব্যক্তির ডাকে, আর মুখে জলের ঝাপটায় চোখ খুললাম। ঘরের মধ্যে দিনের আলো খেলা করছে। পাশের দ্বীপের কৃষক এসে হাজির। সেই আমার জ্ঞান ফিরিয়েছে। আমি ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল, সে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে পারলাম না। আমি তাকে জানাই, আমি এখানে আর থাকতে চাই না, কটা দিন আমি তার বাড়িতে থাকতে চাই। সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে কৃষকের সঙ্গে তার বাড়িতে পাড়ি দিই। পিছনে ছেড়ে দিই ওই ভৌতিক দ্বীপটাকে। এর জন্য ওই কৃষককে অতিরিক্ত টাকাও দিয়েছিলাম।
প্রায় বছর দুয়েক বাদে আরও একবার ওই দ্বীপের পাশ দিয়ে গিয়েছিলাম বেড়াতে। না সেবার আর ওই ভৌতিক দ্বীপটায় নেমে দেখার বা রাত কাটানোর অভিপ্রায় কোনওটাই হয়নি। তবে, দ্বীপটা যেন সেই একই রকম আছে, ঘাটের কাছে বেঁধে রাখা ডিঙি নৌকাটাও। দ্বীপটার পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল।
আইল্যান্ডটা বাঁক নিয়ে যখন পার হচ্ছি, একবার দেখলাম, পিছনে একটি ডিঙি নৌকা করে স্থানীয় আদিবাসী আমাদের দিকে যেন এগিয়ে আসছে, এক মুহূর্তে যেন পুরনো ভয়টা জাঁকিয়ে বসলো। আমরা দ্রুত নৌকা বেয়ে দ্বীপটাকে ছাড়িয়ে চললাম। দূর থেকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে দ্বীপটার দিকে খেয়াল রাখলাম, ধীরে ধীরে দ্বীপটা মিলিয়ে গেল। ভয়টা কাটলেও, পুরনো স্মৃতিতে জমে থাকা যে আতঙ্ক সম্পূর্ণ মন থেকে মুছে যায়নি, তা বেশ অনুভব করতে পারলাম।
অ্যালজারনোন ব্ল্যাকউড –অনুবাদ- পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।