Breaking News

সন্তানসম্ভবা নারী বছরের প্রথম ১৫ দিন গ্রামে থাকেন না! বাংলার এমন এক আজব গ্রামের বিচিত্র প্রথা

পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়–  মানব কল্যাণ, সভ্যতা ও গোষ্ঠীকে বেঁধে রাখতেই এক সময় জন্ম নিয়েছিল প্রথা, সংস্কার। আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজতো বদলায় কিন্তু প্রথা! না পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় না।

আজ এমন এক গ্রামের কাহিনি বলবো, যেখানে এক উত্সবকে কেন্দ্র করে দেখা যায় নানা প্রথা বা সংস্কার। অনেকের নজরে কুসংস্কার বা কুপ্রথা হলেও, তা চলে আসছে এক অদ্ভুত বিশ্বাসের আধারশীলাকে কেন্দ্র করে।  এই গ্রামে এক দেবীর পুজো হয়। আর এই পুজোকে কেন্দ্র করে বাংলা বর্ষের প্রথম মাসেই শুরু হয় সাজো সাজো রব। 

১৫ বৈশাখ পর্যন্ত গ্রামের মধ্যে কোনও বিবাহ, অন্নপ্রশান উপনয়ন এমনকী সাধভক্ষনও হয় না।  বৈশাখের প্রথম পাঁচদিন কারও বাড়িতে কোনও লেখাপড়া হয় না।  উত্তরদ্বারের ঘরে মাসের ১৫দিন কেউ থাকে না।  সমস্ত বৈশাখ মাস জুড়ে যা কিছু লেখাপত্র চলে লাল কালিতে, কালো কালির ব্যবহারের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা।  কেউ সলতে পাকায় না, অন্নে কাঠি দেয় না, কলাই ভাঙে না, ধান ভাঙে না।  সন্তান সম্ভবা নারী গ্রামে থাকে না।  গ্রামের মেয়ে হলে চলে যেতে হয় শ্বশুরবাড়িতে। আর বধু হলে যেতে হয় বাপের বাড়িতে।

এই দিঘিতে সারাবছর রাখা থাকে যোগাদ্যাদেবীর বিগ্রহ

আজব প্রথা আরও আছে।  এই সময় গ্রামের আচার্য মশাই তালপাতায়  লিখে সারা বছরের ফল  প্রচার করেন। তিনিই বলে দেন, কে রাজা হবেন, কে মন্ত্রী। যে বছর আচার্য মশাই ঘোষণা করেন মঙ্গল বা শনি মন্ত্রী হবেন, সেদিন গ্রামবাসীরা সকলে মিলে বলেন, আচার্য মশাই এবার খারাপ মন্ত্রী দিয়েছেন, সারা বছর খারাপ যাবে। 

অতএব আচার্যকে প্রহার করো, পাঁজি ছিঁড়ে ফেলো।  চলে প্রহারের অভিনয়, আচার্য ভয় পাওয়ার অভিনয় করে এলাকা থেকে পালিয়ে তালপাতার পাঁজি ছিঁড়ে ফেলে দেন।  যে বছর আচার্য ভালো মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন, সেই বছর, আচার্যকে কাঁধে তুলে নৃত্য করেন গ্রামের লোক।

হ্যাঁ এমনই বিচিত্র প্রথা ও মজাদার সংস্কারের ছবি যে গ্রামে দেখা যায়, তার নাম ক্ষীরগ্রাম। বর্ধমানের ক্ষীরগ্রাম।  কিংবদন্তী রয়েছে, এখানকার দেবী একান্নপীঠের অন্যতম। দেবীর নাম যোগাদ্যা।  বৈশাখ সংক্রান্তির দিন ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যাদেবীর মহাপুজো হয় এবং সেই উপলক্ষে আগে বিশাল মেলা বসতো। 

কিংবদন্তী রয়েছে, আগে দেবার কোনও মূর্তি ছিল না।  সেই সময়ও পুজো ও মেলা হত। কথিত রয়েছে ক্ষীরগ্রামের রাজা হরিদত্তকে দেবী উগ্রচণ্ডারূপে স্বপ্নাদেশ দেন। তাঁর মূর্তির তৈরি হবে, কষ্টিপাথরে সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী দশভূজা। রাজার বিধানমতে উগ্রচণ্ডাদেবী যোগাদ্যা নামে পুজিত হতে থাকেন।

ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্য়াদেবীর শাঁখা পরা নিয়ে একটি কাহিনি রয়েছে।  কবি কৃত্তিবাস যোগাদ্যা বন্দনায় লিখেছেন, ক্ষীরগ্রামের বর্তমান বসতি থেকে  কিছু দূরে ক্ষীরদিঘির দক্ষিণে ধামাচ নামে একটি বড় পুকুর রয়েছে।  সেখানে শাঁখারিঘাট নামে একটি ঘাটও আছে। 

কবিদের লেখায় পাওয়া যায়, এই ঘাটে এক পরমাসুন্দরী যুবতী স্নান করছিলেন। সেই সময় পাশ দিয়ে এক শআঁখারি যাচ্ছিলেন। তাঁর কাছে শাঁখা পরেন এবং যুবতী বলেন, মন্দিরের পুজারী হচ্ছেন তাঁর বাবা, তাঁর কাছে যেন শাঁখার দাম তিনি নিয়ে নেন।

শাঁখারি মন্দিরে গিয়ে পুজারিকে গিয়ে বললে, পুজারি শাঁখারিকে বলেন, তাঁর কোনও মেয়ে নেই, ফলে শাঁখার দাম তিনি দিতে পারছেন না।  শাঁখারি জানান, তিনি গরিব, তাঁর বিপদে যেন না ফেলেন পুজারি সঙ্গে অনুনয় বিনয় করতে থাকেন। এমন সময় পুজারির চোখ যায়, মন্দিরের ভিতরে কুলুঙ্গির দিকে। সেখানে পাঁচ টাকা দেখতে পান। এটা দেখেই পুজারির কেমন একটা সন্দেহ হয়।

পুজারি শাঁখারিকে বলেন, আগে ঘাটে চলো, দেখবো তোমার কাছে কে শাঁখা নিয়েছে তারপর টাকা দেবো।  নয়তো রাজাকে বলে শাস্তি দেওয়ানোর বন্দবোস্ত করবো।  শাঁখারি কাঁদতে কাঁদতে পুজারির সঙ্গে ঘাটে আসে। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না।

পুজারি যখন তাকে রাজার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করছে, তখনই পুকুরের মাঝখান থেকে একজোড়া শাঁখা পরা হাত দেখতে পাওয়া যায়। তখন পুজারি ও শাঁখারি দুজনেই বুঝতে পারেন, এ আর কেউ নন, যোগাদ্যাদেবী।  শাঁখারি আর শাঁখার দাম নিল না।  সেই শাঁখারির আসল নাম ও ধাম কিছুই জানা যায় না। যদিও প্রথা মেনে এখনও মন্দিরের কুলুঙ্গিতে পাঁচ টাকা রাখা থাকে। আর বৈশাখি পুজোর দিন দেবীকে শাঁখা দেওয়ার রীতি চালু আছে।

যোগাদ্যা দেবীর বিগ্রহ সারা বছর মন্দিরসংলগ্ন পুকুরের জলের মধ্যে সমাধিস্থ করা থাকে। প্রতি বছরের বৈশাখ সংক্রান্তিতে জল থেকে তুলে পুজো করা হয়। এই সময় গোটা গ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়।  দেবীর আগে যে মূর্তি ছিল, তা হারিয়ে যাওয়ার পর, নতুন বিগ্রহ তৈরি করানো হয়।

বর্তমানে মূর্তিটি কালো পাথরের। মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন দাঁইহাটের ভাস্কর, নবীনচন্দ্র ভাস্কর। তবে কয়েকবছর আগে পুকুরের সংস্কারের সময় পুরনো মূর্তিটি উদ্ধার হয়। ফলে পুরনো মূর্তিকে রাখতে আরও একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

অম্বিকা-কালনা, নামের মধ্যেই কি লুকিয়ে রয়েছে ধর্মান্তরিত দেবদেবীর ইতিহাস!

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– বর্ধমান জেলার বিখ্যাত জায়গা কালনা।  অম্বিকা কালনা। এই জায়গার এক বিচিত্র ইতিহাস রয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!