পাঞ্চালী রায়চৌধুরী- ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগেসিল্কের জন্ম হয়েছিল চিনে। প্রথম দিকে সিল্কের ব্যবহার চিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সিল্করুট খুলে যাওয়ার পর, তা ভারত ও মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমী দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তী সময়ে ভারতেও সিল্কের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একসময় ভারতীয় সিল্কের চাহিদা সারা বিশ্বে তৈরি হতে থাকে। আজও ভারতীয় সিল্কশাড়ির কদর বিশ্বজুড়ে রয়েছে। একটা সময় ছিল শাড়ি হাতেই বোনা হত। সময়ের সঙ্গে আধুনিক মেশিন এসেছে। অর্থাত হাতে বোনাকে বলে হ্যান্ডলুম আর মেশিনে বোনাকে বলে পাওয়ারলুম।
মেশিন আসার পরেও দেখা গিয়েছে, বহু শাড়ির ক্ষেত্রে হাতে বোনা কাপড়ের গুনমানের ধারে কাছে আসে না পাওয়ারলুমের কাজ। যেখানে হ্যান্ডলুমে একটি শাড়ি বুনতে এক মাস, কখনও চার পাঁচ মাস (ডিজাইনের উপর নির্ভর করে)। সেখানে পাওয়ারলুমের একটি শাড়ি বুনতে কয়েক ঘণ্টা থেকে তিন চার দিনে সম্পূর্ণ হয়।
পাওয়ারলুমে সময় বাঁচে বলে দামটাও কম হয়। আর হ্যান্ডলুম প্রোডাক্টের দাম স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হয়। এবার আসি ভারতের অঞ্চলভেদে বেশ কিছু জনপ্রিয় সিল্কের তথ্য সম্পর্কে। আমাদের দেশে ২৬টির মতো জনপ্রিয় সিল্কের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
১। অসম সিল্ক শাড়ি– ভারতের প্রায় অধিকাংশ মহিলারই একটা স্বপ্ন থাকে অসমের সিল্ক শাড়ি সম্পর্কে তার অন্যতম কারণ হল, এর একটা ঐতিহ্য আছে, বনেদিয়ানা আছে, রয়েছে আভিজাত্য। ওজন কম, ও মোলায়েম সিল্কসুতোর ধরণ।
অসম সিল্কের প্রচীন একটা ঐতিহ্য রয়েছে। অসম সিল্কের তিনটি ধরণ দেখা যায়, মুগা সিল্ক, পাট সিল্ক এবং এরি সিল্ক। তিনটি ধারাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঐতিহ্যগত অসম সিল্ক শাড়ি পুরোপুরি হ্যান্ডলুমের উপর এখনও নির্ভরশীল। এখানে একটি শাড়ি শেষ হতেই প্রায় মাস কানেক সময় লাগে। তবে দামের বিচার করলে, পাটোলা সিল্ক বা কাঞ্জিভরম সিল্কের তুলনায় দাম কম। অসম সিল্ক শাড়ির রেঞ্জ মোটামুটি শুরু হয় ৫০০০ টাকা থেকে।
২। আর্ট সিল্ক- এটি মূলত কৃত্রিম সিল্ক। এই সিল্ক তৈরি হয়, সিন্থেটিক ফাইবার থেকে। অনেকে এটিকে বাম্বু সিল্কও বলে থাকেন। রেওন সিল্ক ও আর্টসিল্ক একই বস্তু, আলাদা কিছু নয়। আর্ট সিল্ক শাড়ি অন্যান্য সিল্কের থেকে দাম অনেকটাই কম। ইউরোপে প্রথম কৃত্রিম সিল্ক তৈরি হয় ১৮৯০ সালে। মূলত তুলো (সেলুলোস ফাইবার) থেকে একটা সময় পশ্চিমের পাশাপাশি এশিয়াতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইংরেজদের দাক্ষিণ্যে। পরে নাইলন, পলিস্টার, রেওনও কৃত্রিম সিল্কে জায়গা নেয়।
আর্ট সিল্ক বিশ্ব বাজারে বিপুল বাজার দখল করে রয়েছে, দাম কম হওয়ার দরুন। এই সিল্কের শাড়ি নিম্ন থেকে উচ্চবিত্ত বহু শ্রেণির মহিলারা ব্যবহার করেন। পশ্চিমী দুনিয়া থেকে এই সিল্কের বিপ্লব ঘটার ফলে ভারতের আদি দামি ঐতিহ্যবাহী সিল্কের বাজার অনেকটাই খেয়ে নিয়েছে। কারণটা খুব সহজ, ক্রয় ক্ষমতা।
সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে, আর্ট সিল্ক শাড়ি হাতে বোনা একদমই সম্ভব নয়। এটি সবসময় মেশিনে বুনতে হবে। অর্থাত আর্ট সিল্ক শাড়ি মানেই পাওয়ারলুম প্রোডাক্ট। এখানে একটি কথা খুব স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। অন্যান্য সিল্কের সঙ্গে রেওন বা আর্ট সিল্ক মিশিয়েও শাড়ি প্রস্তুত হচ্ছে।
অবশ্যই তা তৈরি হচ্ছে পাওয়ারলুমে। কিন্তু সেটিকে একদম আসল সিল্ক বলে অনেকে চালান। এবং দামও আসল সিল্কের মতো নেন। ফলে, সেটা বুঝে নেওয়া, চেনা ও অত্যন্ত বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এই সিল্কের শাড়ির রেঞ্জ মোটামুটি ১০০০ টাকা থেকে শুরু।
৩। বেনারসী সিল্ক- বেনারসী সিল্ক, ভারতের উচ্চমার্গের সিল্ক শাড়ির অন্যতম। এর গোত্রই আকদম ভিন্ন। বেনারসী শাড়ির বৈশিষ্ট হল, সোনার কাজ, টানটান বুনোট, ছোট ফিগার, মেটালিক ভিস্যুয়াল, পল্লু, জাল, মিনার কাজ থাকবে।
ভারতের বিয়ে বাড়ির মানেই বেনারসী শাড়ি। ফলে বছরভর এর একটা আলাদা চাহিদা রয়েছে। আর এর এক এবং অদ্বিতীয় সুতিকাগার অবশ্যই আলোর শহর বেনারস। অনেকে ডিজাইন নিয়ে ভিন্ন এলাকায় তৈরি করেন। সেগুলি বেনারসী বলেন, কিন্তু আদৌ বেনারসী শাড়ি নয়।
একটা বিষয় খুব ভালো করে মাথায় রাখা উচিত, অঞ্চল ভেদে যে সিল্কের কথা বলা হচ্ছে, সেই সিল্কের সুতো কিন্তু সেখানকার জলহাওয়া, রেশম প্রস্তুত করার পদ্ধতি, পরম্পরাগত কারিগরি দক্ষতা এসব মিশে থাকে। যা অন্য জায়গায় অসম্ভব। সেটাই তার স্বকীয়তা। নয়তো সেটা হবে নকল, নকল, নকল। এবার আপনারাই ঠিক করবেন, আসলেক টাকা দিয়ে নকল জিনিস কিনবেন কি কিনবেন না।
আগেই বলেছি, বেনারসী হ্যান্ডলুমের শাড়ি তৈরি হতে প্রায় দিন পনেরো কখনও মাস ছয়েক সময় লাগে। ফলে দামও সেই রকম। বেনারসী সিল্ক শাড়ির ডিজাইনে মূলত যে ঐতিহ্যবাহী ধার দেখা যায়, তা হল, জাংলা, তাঞ্চোই, ভাস্কট, কাটওয়ার্ক, তিসু ও বুটিদার। বেনারসী শাড়ির আবার একাধিক ভ্যারাইটি দেখা যায়, যেমন পিওর সিল্ক বা কাতান, অর্গাঞ্জা বা কোরা, সঙ্গে জরি ও সিল্ক, জর্জেট এবং শাটির।
বেনারসীর হ্যান্ডলুম প্রোডাক্ট নিতে হলে বাজারে মোটামুটি রেঞ্জ হচ্ছে ২০ হাজার থেকে শুরু হয়। বেনারসী সিল্ক শাড়ি ব্রাইডাল কালেকশনের দাম ২ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।
৪। বালুচরী সিল্ক শাড়ি- বালুচরী আমাদের বাংলার আদি ঐতিহ্যবাহী সিল্ক। এর জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার হলেও, বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। ২০০৯-১০ সালে বালুচরী ডিজাইনের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছিল।
বালুচরী শাড়ির ডিজাইনের মধ্যে মূলত যেটি লক্ষ্য করা যায় তা হল, পৌরাণিক কাহিনি। রামায়ণ, মহাভারতের চরিত্র ও কাহিনির অংশ। এই শাড়ি তৈরি করতে একজন তাঁতির প্রায় সপ্তাহ খানেক সময় লাগে। বাংলার নবাবী আমলে ও ইংরেজ শাসনকালে বালুচরী শাড়িতে ডিজাইনের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সেই ধারাও এখনও রয়েছে। এই সিল্কের সুতো তৈরি হয়, রেশমপোকা থেকে।
বালুচরী শাড়ি তৈরির পর পালিশ করা হয়, তারপরেই আসল জেল্লা বেরিয়ে আসে। সেটা অবশ্য অন্যান্য হ্যান্ডলুম সিল্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । এই শাড়ির রেঞ্জ মোটামুটি বাজারে ২০ হাজার থেকে শুরু হয়, ২ লক্ষ টাকারও শাড়ি বাজারে মেলে।
৫। বোম্কাই সিল্ক শাড়ি- বোম্কাই সিল্ক হল, ওডিশার গঞ্জাম জেলার প্রাচীন সিল্ক। এখানকার সিল্ক থেকে প্রস্তুত হওয়া শাড়িকে সোনপুরী শাড়িও বলে। এই শাড়িতে ঐতিহ্যবাহী যে ডিজাইন দেখা যায়, তা হল মাছের মোটিফ। প্রচীন লোকবিশ্বাস শাড়িতে মাছের চিত্র মঙ্গলকর। মাছের মোটিফের পাশাপাশি আধুনিক ডিজাইনও দেখা মেলে বাজার চাহিদার উপর।
বোম্কাই শাড়ির রেঞ্জ শুরু হয় মোটামুটি ১০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আপনাদের হয়তো মনে আছে, ঐশ্বর্য রায় বচ্চন বিয়ের সময় এই বোম্কাই শাড়ি পরেছিলেন। ডিজাইন ছিল রাধাকুঞ্জ। শাড়িটি তৈরি করেছিলেন, সোনপুরের চতুরভুজ মেহের।
আগামী পর্বে থাকছে, ভাগলপুর, চান্দেরী, ধর্মাভরণ, ব্যাঙ্গালোর, গাড়োয়াল ও অন্যান্য সিল্ক শাড়ির তথ্য।
পাঞ্চালী রায়চৌধুরী একজন বাংলার জনপ্রিয় পেশাদার টেক্সটাইল কন্সালটেন্ট। ভারতের প্রচীন ঐতিহ্যবাহী শাড়ি, জুয়েলারি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। ওনার একটি সংস্থা রয়েছে নাম ORDER PRIME এ বিষয়ে আরও নানা ধরণের আপডেট পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করতে পারেন।