Breaking News

রাম নামের মাহাত্ম্য কীভাবে ছড়িয়ে গেল সারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়! আজও রহস্য

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত দুটি মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত। বাল্মীকি রচিত রামায়ণ ও ব্যাসদেব রচিত মহাভারত সহস্রাব্দ পার করেও বিশ্বমাঝে আজও সমাদৃত। সারা বিশ্বে মহাকাব্যের ব্যপ্তি ও আলোকময় ছটায় ধারে কাছে কেউ নেই। হোমারের ইলিয়াড ওডিসি নেহাতই শিশু।

তবু ভারতের মধ্যেই এই দুটি মহাকাব্যকে ঘিরে রয়েছে নানা বিতর্ক। একটা অংশ মনে করেন, এটি নিছক কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি রচিত কাব্য বিশেষ, আর একটা অংশ মনে করেন এই মহাকাব্যের মধ্যে যেমন রয়েছে নীতিকথা, তেমনই ইতিহাস। সত্য সন্ধানের ইতিহাস ও দর্শন।

সুমাত্রা বালিতে রামায়ণের লোকনৃত্য

আবার একটা অংশ মনে করে, ভারতের একমাত্র গোবলয় মানে উত্তরপ্রদেশ ছাড়া আর কোথাও রামায়ণের কদর নেই। কথাটাকি সত্যি নাকি একটা ভ্রান্ত ধারণা, নয়তো আসল সত্যকে চেপে রাখার একটা ষড়যন্ত্রমূলক প্রয়াস। রামায়ণকে ঘিরে ভারতের মধ্যে যতটা বিভাজন দেখা যায়, সারা বিশ্বে আর কোথাও দেখা যায় না। অনেকে হয়তো বলবেন, রামায়ণের সঙ্গে সারা বিশ্বের যোগ কী করে এলো!

তাহলে একবার নজর ফেরানো যাক, প্রাচীন লোকসংস্কৃতিতে। কারণ লোক সংস্কৃতি, লোকনাট্য, লোকনৃত্য, লোককথাই প্রচীন জনজাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে বহন করে চলে। প্রথমে আসা যাক, ভারতের বুকে, ভারতে প্রচীন লোকগানে যেমন রামায়ণ রয়েছে, তেমনই পিছিয়ে পড়া অনুন্নত জনজাতির নৃত্যের মধ্যেও রামায়ণের মাহাত্ম্য দেখা যায়। তার অন্যতম নিদর্শন। ছৌ নাচ। ভারতে প্রাচীন তিনটি ঘরানার ছৌনাচ দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, ওডিশার ময়ূরভঞ্জ ও ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেল্লা।

এই তিনটি ঘরানার লোকনৃত্যতে অংশ নিতে দেখা যায়, ছোটনাগপুর মালভূমির আদি জনজাতিগোষ্ঠীকেই। এখানে উঁচুজাতের বা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত নয়। এতো গেল ভারতের লোকনৃত্য। রামায়ণকে কেন্দ্র করে প্রাচীন লোক নৃত্যু দেখা যায় শ্রীলঙ্কাতেও। অনেকেই হয়তো দাবি করবেন। রামায়ণের প্রেক্ষাপট যেহেতু লঙ্কাকে ঘিরে রয়েছে, তাই দক্ষিণভারতসহ লঙ্কাতেও তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।

থাইল্যান্ডের লোকনৃত্যে রামায়ণ

লোক সংস্কৃতির ইতিহাস বলছে, শুধু ভারত নয়, গোটা সাউথ ইস্ট এশিয়া জুড়েই হাজার হাজার বছর ধরে লোকনৃত্যে পালন করা হয় ভগবান রামের মাহাত্ম্য। প্রথমেই আসা যাক থাইল্যান্ডে। এদেশের লোকনৃত্যেও দেখা যায় রামের মাহাত্ম্য ও গুনগান- এখানে যে লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়, তার নাম রামাকেন- ভগবান রামের নাম অনুসারে এখনও থাইল্যান্ডের রাজার নামের সঙ্গে রামশব্দটি জুড়ে থাকে।

কম্বোডিয়ার লোকনৃত্যে রামায়ণ

থাইল্যান্ডের প্রাচীন রাজধানী আয়ুত্থা আসলে অযোধ্যার অপভ্রংশ রূপ। এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের যখন প্রভাব বিস্তার হতে থাকে, বুদ্ধের জাতক কাহিনিতে জুড়ে যায় রামের নাম। থাইল্যান্ডে দশরথ জাতক পর্বকথা বৌদ্ধধর্মের কাহিনিতেও রয়েছে। থাইল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ রাম, প্রচীন লোকনৃত্যকে আরও বড় আকারে তুলে ধরতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বাল্মিকী রামায়ণ, বিষ্ণুপুরাণ, হনুমানকথা থেকে অংশ নিয়ে রামায়ণ লেখানোর কাজে উত্সাহ দেন।

থাইল্যান্ড থেকে এবার মুখ ফেরানো যাক, ফিলিপিন্সের দিকে। এখানে যে লোককাহিনিটি রয়েছে, তার নাম মাহারাদিয়া লাওয়ানা- উচ্চারণ টানে বোঝা যায়, মহারাজা রাবণ। এই লোককাহিনিতে জায়গা ও চরিত্রের নাম ভিন্ন হলেও, কাহানি বিন্যাস, ঘটনাপরম্পরা, চরিত্র সম্পূর্ণ মিলে যায় বাল্মিকী রামায়ণের সঙ্গে।

লাওসের লোকনাট্যে রামায়ণ

বালির সুমাত্রা দ্বীপে যখন বৌদ্ধ ধর্ম জাঁকিয়ে বসেছে, সেই সময় নতুন করে উত্থান হয় রামায়ণ কথার। অষ্টম থেকে নবম শতকে সুমাত্রার লোকনৃত্যে পাকাপাকি জায়গা করে নেয় রামায়ণের গল্পকথা। এখানে রামায়ণ পরিচিত কাকাউইন রামায়ণ নামে।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ছোট দেশ লাওস। এখানের প্রাচীন লোকনাট্যে জুড়ে রয়েছে রামের নাম। রা লাক, রা রাম। লাওসের জাতীয় মহাকাব্য। এখানেও দশরথ জাতক থেকে কাহানি এসেছে। এখানে বুদ্ধই হল রাম। ভারতের পুরাণ ও মহাকাব্যে যে চম্পানগরীর কথা বলা রয়েছে, তা বর্তমানের ভিয়েতনাম। এদেশেও বহু প্রাচীন হিন্দু মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। একটা সময়ে লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের সাম্রাজ্য একত্রেই ছিল, কম্বোডিয়াতেও রামায়ণের রূপ হচ্ছে রেমকের। কম্বোডিয়ার জাতীয় মহাকাব্য রেমকের-এর অর্থ হল, রামের গৌরব।

ফিলিপিন্সের লোকনৃত্যে রামায়ণ

কম্বোডিয়ার রামায়ণের ক্ষেত্রে কাহানির মূল পর্ব এক হলেও, বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন বাল্মিকী রামায়ণে হনুমানের কোনও স্ত্রীয়ের কথা উল্লেখ নেই। কম্বোডিয়ার রামায়ণে কিন্তু হনুমানের স্ত্রী রয়েছে। তার নাম শোভান্না মচ্ছা। কম্বোডিয়ার মহাকাব্যে তিনি এক মত্স্যকন্যা। হনুমান ও বানর বাহিনী যখন রামসেতু যখন তৈরি করছে, সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল শোভান্না।

এখন এখানে প্রশ্ন আসে, রামায়ণের মতো একটি কাল্পনিক মহাকাব্য, দেশ সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা সাউথ ইস্ট এশিয়ার লোকনাট্য, লোকনৃত্যের অঙ্গ কীভাবে হয়ে উঠল! বৌদ্ধ ধর্মের যেভাবে বিস্তার হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে ইসলাম ধর্মেরও প্রভাব বিস্তার হয়েছিল। কিন্তু রামকথা জনমানসে এমন ভাবে জায়গা করলো, যেখানে কোনও রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের কথা উল্লেখ নেই।

একাংশ গবেষকের মত, ভারতের প্রাণকেন্দ্র অযোধ্যা থেকে রামের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ার পিছনে বৌদ্ধ ধর্মের জাতক কাহিনির গুরুত্ব রয়েছে। জাতকের গল্পকে আধার করেই রাম জায়গা করে নিয়েছে। যদিও অন্য অংশের মত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আদি জনজাতিদের মধ্যে রামের প্রভাব আগে থেকেই ছিল। তাদেরকে ধর্মীয়ভাবে সংগঠিত করতে রামেরই দ্বিতীয় অবতার বুদ্ধ, এটা তুলে ধরা হয়েছে জাতকের গল্পে। যাতে ধর্মীয় ভাবে তাদের অনুভূতিতে আঘাত না করে নতুন ধর্মে একাত্ম করানো যায়।

ধর্মপ্রচারের পথ, বা পদ্ধতি, কাহানি যাই হোক না কেন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন লোকনাট্য, লোকনৃত্যে যেভাবে রামায়ণ বটবৃক্ষের মতো শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, এবং এখনও টিকে রয়েছে স্বমহিমায়, আর কোনও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়াই, এটাই আজকের দিনে বিস্ময়।

ইতিহাসকে ভালো করে ঘাঁটলে দেখা যাবে। ইহুদি, পারসি, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম। এই প্রথম সারির ধর্মগুলির এক এক সময়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ধর্মগুলি বিস্তারের পিছনে ধর্মপ্রচারকদের ভূমিকা ছিল অপার। এতো কিছুর পরেও রামায়ণ মহাকাব্য, যেভাবে লোক সাহিত্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল, আর কোনও ধর্মের কাব্য এভাবে আদি জনগোষ্ঠীর মনে জায়গা করে নিতে পারেনি।

Please follow our facebook page click here

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

কাশ্মীরের এই পাঁচটি জায়গা একদম অফবিট, এবারে সফরের তালিকায় অবশ্যই রাখুন

স্বাতী চ্যাটার্জি- ভূস্বর্গ কাশ্মীর, মুঘল সম্রাট এই উপত্যকা দেখার পর বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!