পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি–লোকশিল্পের রত্নভান্ডার যদি বলা হয়, বিষ্ণুপুরকে তাহলে অনেকটাই কম বলা হবে। যদিও বর্তমান চিত্র ধরলে লোকশিল্পের বহু কিছুই অবলুপ্তির পথে।
বাঁকুড়ার সফর অনেকেই করেছেন, গিয়েছেন বিষ্ণুপুরও, অনেকেরই জানা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিষ্ণুপুর ঘরানা এখনও বিরাজমান। মল্লরাজাদের ইতিহাস তার সঙ্গে মদনমোহনের কাহিনী সব মিলিয়ে মিশে এক অরূপ নগরী। বাংলার টেরোকোটা শিল্পকলার আন্তর্জাতিক স্তরে বিজয় ধ্বজা আজও আমাদের গৌরব তুলে ধরে।
উইকেন্ড হোক বা দেশ, বেড়ানোর সেরা
গ্রুপে যুক্ত হতে চাইলে ফোন করুন 9073503958
কিন্তু এই মল্লরাজাদের ঘরানাতেই ছিল এক অসাধারণ, অতুলনীয় জনপ্রিয় খেলা। দশাবতার তালের খেলা। এই দশাবতার এক আজব এবং অদভুত ধরণের খেলা মল্লরাজ ঘরানায় যুক্ত হওয়ার পিছনেও এক লুকনো কাহিনি রয়েছে, সেই আলোচনা অন্য দিন করা যাবে, আজ যেটা প্রকাশ করবো, তা হল, এই খেলার নিয়ম কানুন, আদব কায়দা।
বিষ্ণুপুরের কিছু প্রবীণ মানুষ আর এই বাংলার হাতে গোনা কয়েকটি মানুষই এই খেলার কৌশল রপ্ত করেছেন, আর সেটাই একমাত্র আপনাদের কাছে আমি শেয়ার করছি। দশাবতার, বিষ্ণুর দশটি অবতারের কল্পনা বহু প্রাচীন। কিন্তু বিচিত্র রঙে ঢেলে, তার মধ্যে তালমেল ও রঙের সঙ্কেতকে আধার করে খেলার কৌশল তৈরি করার প্রয়াস ঠিক কত দিন আগে হয়েছিল, তা বলা মুশকিল।
এই দশাবতার তাস খেলায় মোট দশটি অবতারের ১০টি প্রধান তাস থাকে। সেখানে দশটি অবতারের মূর্তি আঁকা থাকে। আর এই দশ খানি তাসের বা অবতারের একজন করে উজির রয়েছে, তাদেরও আলাদা ভাবে আঁকা তাস থাকে। আর এই প্রত্যেক উজিরের অধীনে আবার দশ খানি করে তাস থাকে। অনেকটার সমাজের বিভিন্ন স্তরকে প্রতিফলিত করার মতো।
আধুনিক তাস খেলায় যেমন দশ, নয়, আট, সাত, ছক্কা, পঞ্জা, চৌকা, তিরি, দুরি, টেক্কা থাকে। অনেকটাই সেই ধাঁচে, এখানে অবতারের ক্ষমতা বা পয়েন্ট সব চেয়ে বেশি। অবতারের অধীন উজির, তাদেরও প্রভাব যথেষ্ট। পুরো খেলাটার মধ্যেই যেন রয়েছে, আমির ওমরাহ, জমিদার থেকে পাইক বরকন্দাজ। দাবার চালও যেন উঠে এসেছে তাসে।
আরও পড়ুন- বাঁকুড়ার ৫টি রহস্যময় এলাকা
মোট ১২০টি তাস। প্রধান তাসের অবতারের প্রতীক হল, রাম-তীর। বলরাম-গদা। পরশুরাম-কুঠার। নৃসিংহ-চক্র। বামন-কমণ্ডলু। জগন্নাথ (বুদ্ধ)-পদ্ম। বরাহ-শঙ্খ। মৎস্য-মৎস্য। কূর্ম-কূর্ম। কল্কী-খড়্গ। এই সবই প্রতীক আঁকা হয়, থাকে রঙের তারতম্য। তবে দশ অবতারের মধ্যেও পাঁচ অবতার রাম, বলরাম, পরশুরাম, জগন্নাথ (বুদ্ধ) ও কল্কীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এই পঞ্চ অবতার ও পঞ্চ উজিরের পরেই টেক্কার স্থান। তারপর দুরি, তিরি, চৌকা ইত্যাদি। দশের স্থান সবার নীচে।
বাকি পাঁচ অবতার মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন। এদের উজিরের পরেই দশই হল সম্মানিত কার্ড এবং যথাক্রমে এদিকে টেক্কার মর্যাদা সবার কম॥ শুধু তাই নয়, দিনের বেলা খেলা শুরু হলে রাম অবতার স্টার্টার হন, আর রাতে খেলা শুরু হলে মৎস্য স্টার্টার। মোট খেলোয়াড় থাকেন পাঁচ জন। এখানে কোনও খেলোয়াড় কারও সঙ্গী বা পার্টনার হবে না। তবে শুরু ডান দিক থেকেও হতে পারে বা বাঁ দিক থেকে। যে দিক থেকেই শুরু হোক না কেন, খেলা চলবে ওই ধারাতেই।
দিনে খেলা শুরু হলে, যার হাতে রামের তাস পড়বে তিনি খেলা শুরু করবেন। তাঁর হাতের অবতার উজির ও অন্যান্য অনার্স কার্ডের পিঠ নিয়ে তিনি হাত পেরাবার জন্য অন্যকে ‘সেরোয়া’ বা পাস দেবেন। পরের খেলোয়াড় ঠিক এই ভাবেই খেলবেন। মোট খেলায় ২৪টি পিঠ থাকে। খেলা শেষ হলে, পিঠ গুনে হারজিত নির্ণয় হয়।
আরও পড়ুন- জানুন গনগনির আসল ইতিহাস
কমপক্ষের ৫টি পিঠ ১ পয়েন্ট করে ধরা হবে, তার বেশি পিঠ পেলে দ্বিগুন। ধর যাক কেউ ৭টি পিঠ পেয়েছে,তা হলে তার হবে ১৪ পয়েন্ট। আবার ৫ এর কম হলে, মানে ৩টি পিঠ পেয়েছে, তাহলে তার হয়ে যাবে মাইনাস ৯। তিনগুন কমে যাবে। এই পয়েন্টের উপর বাজি ধরেও কখনও খেলা হয়ে থাকে।
কিংবদন্তি রয়েছে, এই খেলা মূলত মল্লরাজাদের সমৃদ্ধিকালে সূচনা হয়। এ বিষয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে ইতিহাস গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একটি নোট লিখেছিলেন। তাঁর দাবি, প্রায় ১১০০ থেকে ১২০০ বছর আগে এই খেলার সূচনা হয়েছিল বলে তাঁর বিশ্বাস।