Breaking News

এক আজব আঁধারে বাংলাদেশের ‘কাশ্মীর’ প্রায় সরগরম হয় কেন পার্বত্য চট্টগ্রাম?

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা ও ৩৫ ক যেন এ ভয়ঙ্কর বিষফোঁড়া ছিল। অপারেশন কাশ্মীরের পর ভারতের মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাংলার প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রের এক সাংবাদিক ‘অ’নেক কিছু ‘জানে’, তিনিতো বলেই ফেলেছিলেন, কাশ্মীর এবার প্যালেস্তাইন হয়ে যাবে। মজার কথা, এ বঙ্গের কোনও প্রবীণ সাংবাদিকদের পাকিস্তানের হাড়পিস ও বাংলাদেশের কার্বঙ্কল সমস্যা নিয়ে কোনও দিন উচ্চ বাচ্য করতে দেখা যায়নি।

বাড়তি ভণিতা না করে, সমস্যা ও সূত্রপাতে আসা যাক। বছর তিন ও সাড়ে তিন চার বছর আগেরকার ঘটনা। মিজোরামে ৪ ছাত্র এম বি বি এসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পুরো মেধার সঙ্গেই তারা পাস করে, কিন্তু তাঁদের আসন দিতে অস্বীকার করে মিজোরাম সরকার। এই ঘটনার পরেই কেন্দ্র সরকার মিজোরামে ম্যাডিকেলের যে আসন সংখ্যা ছিল তা কম করে দেয়। এটা নিয়ে মিজোরাম ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে একটা চাপান উতোরও শুরু হয়। মিজোরাম সরকার সাফ জানায়, যে ৪ ছাত্রকে আসন দিতে চায়নি কারণ তারা চকমা উপজাতির। মিজো উপজাতির কোটা তাদের দেওয়া হবে না।

এবার আসি এই চকমা কারা, কোথা থেকে এলো ভারতে?

স্বাধীনতার পর থেকে আমরা মানে ভারত মূলত হিন্দি বেল্টকে নিয়েই বড্ড বেশি মাথা ঘামিয়েছি, কিন্তু উত্তর পূর্ব ভারত দীর্ঘ দিন অবহেলায় থেকেছে, সেখানকার সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রে কোনও সরকারই সে ভাবে নজর দেয়নি। আমাদের দেশের মানচিত্র যদি দেখা যায়, ভারতের পূর্ব দিকে বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে বঙ্গোপসাগর ও উত্তর পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য। বাংলাদেশের কিছুটা বর্ডার শেয়ার করে মায়ানমার। বাকি ৯৫ শতাংশই ভারত লাগোয়া।

আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ত্রিপুরা ও মিজোরাম। এই অঞ্চলকেই বাংলাদেশে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা। আর এই চট্টগ্রাম ডিভিশনের তিনটি জেলা হল, খাগড়াছরি, রাঙামাটি, বান্দরবন। চকমা উপজাতির মানুষদের আদি বাসস্থান এখানেই। এই চকমা জনজাতি কিছু মায়ানমারের দিকে চলে যায়, কিছু চলে আসে ভারতে, কিছু পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এখনও রয়েছে। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কিছু উপজাতি রয়েছে। এই অঞ্চলটি প্রায় ১৩ হাজার স্ক্যোয়ার কিলোমিটার এলাকা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই পার্বত্য চট্টগ্রাম এই বিশাল এলাকা একটা জেলা হিসেবেই পরিচিতি ছিল, পরে তিনটি জেলায় ভাঙা হয়।

এখানকার এই চাকমা উপজাতিরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। ভারতও ও ভারত লাগোয়া দেশগুলি দেখলে, লাদাখ, সিকিম, দার্জিলিং, ভুটান, শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীর প্রভাব বেশি। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে যে উপজাতিরা ছিল, সেগুলি হল, চকমা, হাজোং, সারমা,উইগজহোই, মরো, বৌম, পাংখু, খ্যায়াং, খুমি, চাক, লুসাই, তানচাংগ্যা। এদের সবাইকে মিলিয়ে বলা হয় জুম্মা। জুম্মার কথার অর্থ যাঁরা পাহাড়ের অধিবাসী। এদের মধ্যে সব থেকে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে চকমাদের।

বাংলাদেশ ইসলামিক দেশ, সেখানে হিন্দুদের পাশাপাশি এরাও সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় যে উপজাতিরা রয়েছে, এরাই এখানকার আদিম জনগোষ্ঠী। আর এখানকার উপজাতিরা থেরাবারা বৌদ্ধ ধর্মীলম্বী। অখণ্ড ভারতে ব্রিটিশ রাজ শুরু হয়। ১৮৬০ সালে বাংলাদেশেও দখল জমায় ইংরেজরা। ১৯০০ সালে ব্রিটিশরা সি এইচ টি রেগুলেশন বা চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট রেগুলেশন তৈরি করে। রেগুলেশনটি তৈরি হয়, এখানকার এই আদিম জনজাতিদের কথা মাথায় রেখেই। রেগুলেশনে উপজাতিদের স্বায়ত্তকে মেনে নেয় ইংরেজরা। এমনকি এখানকার জমিও ওই জনগোষ্টী ছাড়া আর কেউ কিনতে পারবে না এবং ব্যবহারও করতে পারবে না বলেও নীতি নেয় ব্রিটিশরা।

১৮৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অধুনা বাংলাদেশের এই অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাইরে ছিল। অর্থাত এদের বিষয়ে কোনও দিনই ব্রিটিশরা নাগ গলায়নি। ১৯০০ সালে সি এইচ সি রেগুলেশন, সেই ভাবনায় কার্যত রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করেছিল ইংরেজরা। এর ফলে বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকরা এই অঞ্চলে আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হল, পাশাপাশি দ্বি জাতি তত্ত্বে দেশও ভাগ হল। এই সময়ই এই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মারা ভারতের সঙ্গে থাকতে চায় বলে দাবি জানায়, কারণ সেই সময়ই সেখানে ৯৭ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী।

১৯৪৭ সালে সিলেট ডিভিশন সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে গণভোট হয়, সিলেট ডিভিশনের বহু মানুষ জানায় তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চায়, অন্যদিকে অধুনা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মানুষ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। বিষয়টি নিয়ে জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, সি এইচ টি ইউনিটের সদস্যদের আশ্বস্ত করে, সি এইচ টি ভারতের সঙ্গেই থাকবে।

এখানে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড বলি, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ করে, সেই সময়, সিলেটকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। এবং সিলেটের অংশ ছিল এই সি এইচ টি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু ৪৭ সালে গণভোট হয় সিলেটে। আর সিলেটে যেহেতু মুসলিম জনসংখ্যা বেশি ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকেও যেতে হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। এর পরেই বাউন্ডারি কমিশন বসে, তার প্রধান ছিলেন সিরেল রেডক্লিফ চকমাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন। এখানেই নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ)

আরও পড়ুন- নৃসিংহপুরের রাজবাড়ি কেন ভয়ঙ্কর? কী অঘটন ঘটে ?

আরও পড়ুন- আন্দুল রাজবাড়ি নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ভুতুড়ে গল্পকাহিনি

এটা করার কারণ, ভারতের হাতে ছিল কলকাতা পোর্ট, তাই পাকিস্তানকেও চট্টগ্রাম পোর্ট দিতে হত। যাই হোক, চাকমারা পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির পর, রাঙামাটিতে তারা ভারতের পতাকা তোলে, রাঙামাটি তখনও পর্যন্ত সি এইচ টির সবচেয়ে বড় শহর। ভারতের পতাকা তোলার পরেই, পাকিস্তানের তরফে তাদের বিশ্বাসঘাতক বলতে থাকে।

পাকিস্তান সরকার, এই চকমাদের এক্সক্লিউটেড গ্রুপ (ইংরেজদের দেওয়া) নাম পাল্টে ট্রাইবাল গ্রুপ বলে নোটিফিকেশন করে। এর ফলে যেটা হল, আগে এখানে তাদের উপজাতি ছাড়া যেখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ ছিল, সেখানে অন্যরাও আসতে শুরু করলো। এর পরেই এই অঞ্চলের মূল দুই উপজাতি চাকমা ও হাজোংদের তা়ড়ানো শুরু হয়।

এখানেই পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রোজেক্ট বানানো শুরু করে। এটি ১৯৬২ সালে কমিশন হয়, আর এই বাঁধ তৈরি হওয়ার ফলে প্রায় ১ লক্ষ উপজাতিকে ওই অঞ্চল থেকে সরে যেতে হয়। এখানে প্রায় ৭০ শতাংশ চকমা উপজাতিকে পালিয়ে যেতে হয় নিজ ভূম ছেড়ে। কিন্তু তাদের ঠাঁই হয় না অন্য কোথাও, কারণ ওই অঞ্চল বাদ দিলে ৯৪ শতাংশ জায়গাই মুসলিম অধ্যুষিত।

সেই সময় চকমারা মূলত আসতে থাকে অসমের লুসাই হিল বা পার্বত্য এলাকায়। যা আজ মিজোরাম নামে পরিচিত। এরা উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে ভারত তাদের জায়গা দিতে শুরু করে। ১৯৬৪ সালে অসমের গভর্নর বিষ্ণু সহায় আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অসমের মিজো উপজাতিদের সঙ্গে এই উদ্বাস্তু জনজাতিদের গণ্ডগোল হতে পারে। সেই সময় অসমের রাজ্যপাল, রাজ্যসরকারের কাছে দাবি জানায়, এই চকমাদের পাঠানো হোক, নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সিতে, যা আজ অরুণাচল প্রদেশ বলে পরিচিত।

আরও পড়ুন- রাজস্থান সার্কিটে সফরে দেখুন রাজপুতদের রাজকাহিনি

আরও পড়ুন- জানুন কালাপানি কারাগারের অজানা কথা সঙ্গে আন্দামানের ট্যুর প্ল্যান

১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই চাকমারা তিরাপ, লোহিত ও সুবানশিরি জেলায় ঘর জমায়। অরুণাচলপ্রদেশ এবার আপত্তি জানাতে শুরু করে, কারণ তারাও চাইত না, বাইরের লোক এসে তাদের প্রতিযোগী হোক। তবে সেই সময় অরুণাচলে তেমন জনপ্রিয় নেতাও ছিল না আর সরকারও তেমন ছিল না। ফলে ওখানকার আদি জনজাতিদের আপত্তি থাকলেও, তেমন কেউ গুরুত্ব দেয়নি।

এর পর যখন চকমারা আসতেই থাকে, তখন ওখানে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন তৈরি হতে শুরু করে। এরাই প্রথম চকমাদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করে, এবং দাবি জানায় চকমারা আসলে বিদেশী, ফলে শুরু হয় অ্যান্টি ফরেনার মুভমেন্ট। আশেপাশের রাজ্যগুলিতেও এই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অ্যান্টি চকমা বিক্ষোভ দানা বাঁধে।

এদিকে অসম, ত্রিপুরা, ও মিজোরামে এই চকমারা নাগরিকত্বের অধিকার পেয়ে গিয়েছিল, তাদের তফশিলি উপজাতি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার এই রাইট দেওয়ার ফলে, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অসমে আদি তফশিলি উপজাতি যারা ছিল, তাদের সংরক্ষণে ভাগ জমায় চকমারা।

এদিকে অরুণাচলে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ ছিল চকমাদের নিয়ে। এর কারণটা ছিল, জম্মু ও কাশ্মীর যেমন ভারতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্য ছিল, তেমনই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্য অরুণাচল। বিশেষ সাংবিধানিত রক্ষাকবচ রয়েছে।

প্রসঙ্গে বলে রাখি, জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল, হরি সিঙের ভারতে অন্তর্ভুক্তি ও শেখ আবদুল্লা স্বতন্ত্র ক্ষমতা ভোগের জন্য। জম্মু ও কাশ্মীরের আদি জনগোষ্ঠী যদি ধরা হয় কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। ইসলামিক বা বহিরাগতদের জন্য সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। আর অরুণাচলে রক্ষাকবচ ছিল, আদি জনগোষ্ঠীকে মাথায় রেখেই, যে আরও বেশ কিছু রাজ্যে আছে, স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে নয়। মূল পার্থক্য আদি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই রক্ষাকবচ ধর্মভিত্তিক রক্ষাকবচ দিয়ে প্রদেশ আমাদের সংবিধানে নেই।

অরুণাচলে আশঙ্কার মেঘ তৈরি হতে থাকে, চাকমারা নাগরিকত্ব পেলে, ভোটের অধিকার পেলে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। অরুণাচলবাসীরা মনে করতে শুরু করলো, তাদের এলাকা ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, যেখান সেখান থেকে উদ্বাস্তুদের এনে এখানে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর অসমের সেই সময়কার রাজ্যপাল তাই করেছিল, কারণ অরুণাচলে প্রায় ৭০ শতাংশ জমি খালি পড়ে রয়েছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নিল, পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যায় শেষ হল। এর পরেই চকমারা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করলো। তবে এদের লড়াই শান্তিপূর্ব ছিল না। কারণ বাংলাদেশটাই জন্ম নিয়েছিল গেরিলা যুদ্ধের আবহে। হাতে অস্ত্র তুলে নিল চাকমারা। এরাই অনেকটা গেরিলা কায়দায় প্যারালাল মিলিটারি ফোর্স বানিয়ে ফেলে, যার নাম শান্তি বাহিনী।

এরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বহুবার আলোচনায় বসার ডাক দেয়, কিন্তু সরকার তাদের পাত্তা না দিয়ে সেনা পাঠিয়ে দুরমুস করতে থাকে। ১৯৮৬ সালে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে প্রেসিডেন্ট হুসেন মহম্মদ এরশাদ সংসদে জানিয়েছিল, এক হাজারের বেশি চকমাকে খতম করে দেওয়া হয়েছে।

এর পরেই দেশে অ্যান্টি চকমা সেন্টিমেন্টে হাওয়া লাগে। বাংলাদেশের একাংশ নাগরিক এদের বিশ্বাসঘাতক মনেই করতো, এই অস্ত্র তুলে নেওয়ার পর, সেই ভাবনায় আরও ঘি ঢালে। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক অভিযান চালায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে। সেই সময়, প্রায় ৪৫ হাজার চকমা ও হাজোং ত্রিপুরায় ঢুকে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে। আর এটা হয় মাত্র ১৫ দিনে। জায়গা নেয় ত্রিপুরার উদ্বাস্তু শিবিরে।

আমাদের ভ্রমণ গ্রুপে যুক্ত হতে ছবিতে ক্লিক করুন। আর সমস্ত আপডেট পেতে টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হতে পারেন

১৯৭২ সালে এই শান্তিবাহিনী, শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। অভিযোগ, সেই সময় শেখ মুজিবর রহমান এই চকমাদের কর্মকাণ্ডের উপর প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের কোনও কথা শুনবো না, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। সেই সময়ই সেনা পাঠানো হয়, অত্যাচারের রেকর্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন সংগঠনের নজরে আসে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হত্যার পর, বাংলাদেশ সেনা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই চকমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর পর, একাধিকবার চকমারা নানা সরকারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু কেউই পাত্তা দেয়নি। ১৯৯৬-৯৭ সালে আওয়ামী লিগের সরকার আসে, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা, তিনি চকমাদের বিষয়টি গুরুত্ব দেন প্রথম। তিনি সি এইচ টি অ্যাকর্ড চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এখানে আরও একবার মনে করাতে চাই, এই সি এইচ টি রেজোলিউশন প্রথমে ইংরেজরা। সেই নীতি পরে শেখ হাসিনা মেনে নেন। প্রতিশ্রুতি দেন, চকমাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। এই অঞ্চলে অন্য জায়গার মানুষেরা প্রবেশ করবে না।

এই চুক্তি সময়, সরকারের তরফে বলা হয়, তাদের অস্ত্র ছেড়ে দিতে এবং তাদের স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমি দেওয়া হবে। এদিকে ১৯৯৭ সালে ভারতে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দেয়, ভারতে যে চকমা বা হাজোং উদ্বাস্তু রয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক, যদিও এখনও সেটি কার্ষকর হয়নি। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চকমাদের শান্তি স্বাক্ষর হয়, তখন ভারত সরকার চেষ্টা চালায়, ওদের দেশে পাঠাও, কারণ বাংলাদেশ সরকার ওদের ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে। ২০০৩ সালে প্রায় ৬৫ হাজার উদ্বাস্তুতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। চকমাদের অভিযোগ, তারা দেশে ফেরার পর চুক্তিমতো বাংলাদেশ সরকার ঠিকঠাক প্রতিশ্রুতি পালন করছে না।

ভারতে মূল লড়াইটা কি?

কেন্দ্র বনাম রাজ্য। ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট বললো চকমাদের নাগরিকত্ব দিতে। কিন্তু অরুণাচল প্রদেশের সরকার সেটা করতে পারেনি, কারণ রাজ্যের মানুষ রাস্তায় নেমে যাবে। এই সময়ও ত্রিপুরা, অসম, অরুণাচলে চকমা গো ব্যাক স্লোগান শুরু হয়।

এর মাঝে ১৯৯৫ সালে অরুণাচলের কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জোগং অপাং হুমকিও দিয়েছিল, চকমাদের না সরালে ইস্তফা দিয়ে দেবেন। অন্যদিকে কেন্দ্রও জানায় তাদের পক্ষে এখনই কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই তখন থেকে কেন্দ্র-রাজ্য লড়াই শুরু হয় চকমাদের নিয়ে।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন, যাঁরা হিন্দু উদ্বাস্তু, তাঁরা ভারতে আসতে পারে। এমনকি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ পাস করেন। যদিও একটি কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য, তার মধ্যে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি প্রযোজ্য কিন্তু মুসলিমদের জন্য নয় । তবে সংশোধনীতে নাগরিকত্ব যেটি এগারো বছর ছিল, সেটি কমিয়ে ৬ বছর করা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, মূলত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উদ্বাস্তু হতে হয়।

২০১৫ সালে সুপ্রিমকোর্ট সরকারকে ডেডলাইন দিয়ে দেয়, যে চাকমা ও হিন্দু হাজোং উদ্বাস্তু রয়েছে অরুণাচলে, তাদের অবিলম্বে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক, মানে ১৯৯৬ সালে যে রুলিং ছিল, সেটাকেই পুনর্প্রয়োগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ফলে ২০১৫ সাল থেকে অরুণাচলে চকমাদের বিরুদ্ধে আরও বিক্ষোভ ব্যাপক আকার নেয়।

অরুণাচল ছাড়াও, মিজোরামে ব্যাপক বিক্ষোভ রয়েছে চকমাদের বিরুদ্ধে। এদের চকমা বিদেশী বলা হয়, মিজোরামে, আর স্থানীয় যে উপজাতি রয়েছে, তাদের বক্তব্য এই চকমাদের সংখ্যা দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, চকমাদের সংখ্যা ১ লক্ষ পার করে গিয়েছে। চাকমারা দাবি জানিয়েছে, তাদের আলাদা জায়গা দেওয়া হোক, চাকমাল্যান্ড করে সেটিকে কেন্দ্র শাসিত করা হোক। অরুণাচলে বহু চকমা যারা এখনও উদ্বাস্তু শিবিরে রয়েছে, তাদের অবস্থা এখনও খারাপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ছিটেফোঁটাও পায়নি তারা।

২০১১ সালে বাংলাদেশে জনগণনা হয়, সেই রিপোর্ট অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে ৮ লক্ষ ৪০ হাজার রয়েছে চকমা ও অন্যান্য উপজাতি। আর ৭ লক্ষ ৬০ হাজার রয়েছে মুসলিম বা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকে আসা বাসিন্দারা।

এই পরিস্থিতিতে চকমাদের অবস্থা ভারতেও খারাপ পাশাপাশি বাংলাদেশেও খারাপ, কেন্দ্র সরকার চাইলেও, রাজ্যের বিরোধিতায় সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা সংবেদনশীল এলাকা হিসেবেই রয়েছে গিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের এই অঞ্চ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পর্যটনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভবনাময় এলাকা হলেও, পরিস্থিতি মাঝে মধ্যেই সরগরম হয়ে ওঠে। পর্যটকদের অপহরণ, লুঠ, খুনের খবর প্রায় ভেসে আসে বাংলাদেশের সংবাদ শিরোনামে। বাইরের পর্যটকদের ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা নেয় বাংলাদেশ সরকার।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

মালদ্বীপ যাওয়ার আগে বানিয়ে নিন প্ল্যান, নয়তো খসতে পারে বাড়তি গ্যাঁটের কড়ি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মালদ্বীপ। এই দেশের অধীনে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপের দেশ। ছোট ছোট প্রায় ১২০০ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!